২০ নভেম্বর থেকে পর্দা উঠছে ফিফা বিশ্বকাপ-২০২২ এর। চার বছর পরপর হওয়া বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই আসর এবার বসতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমির। বিশ্বকাপ যতই ঘনিয়ে আসছে সমর্থকদের মাঝে বাড়ছে উত্তেজনা।
প্রতিটি বিশ্বকাপের বল নিয়ে আলাদা এক দুর্বলতা কাজ করে ভক্তদের মাঝে। যা দেখার জন্য চার বছর ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ফুটবলবিশ্ব। ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে হওয়া প্রথম বিশ্বকাপ থেকে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ, প্রতিটি বিশ্বকাপের বলেই আছে বাহারি বৈশিষ্ট্য। সঙ্গে বলেও এসেছে বিস্ময়কর বিবর্তন। প্রতিটি বলের উপকরণ, নকশা ও কার্যকারিতায় এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। জেনে নেওয়া যাক, ১৯৩০ উরুগুয়ে বিশ্বকাপ থেকে ১৯৭৮ আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে ব্যবহৃত প্রতিটি বলের ইতিহাস ও নানা জানা-অজানা তথ্য।
বিজ্ঞাপন
১৯৩০
১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিল উরুগুয়ে। সেবারের বিশ্বকাপের জন্য আলাদা বল তৈরির পরিকল্পনা মাথায় আসেনি ফিফার। ম্যাচের প্রথমার্ধ ও দ্বিতীয়ার্ধে খেলা হত অংশগ্রহণকারী দুই দলের দেয়া বলে।
১৯৩০ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। ম্যাচের প্রথমার্ধে বল দিয়েছিল আর্জেন্টাইনরা। বলটির নাম ছিল টিয়েন্টো। ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ খেলা হয়েছিল উরুগুয়ের দেওয়া দ্য টি-মডেল বলে। টিয়েন্টোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভারী ও আকারে বড় ছিল উরুগুয়ের বলটি। ১২টি প্যানেলের সেই বলটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল ইংল্যান্ডের কোম্পানি জন সল্টার অ্যান্ড সন।
বিজ্ঞাপন
১৯৩৪
ইতালি বিশ্বকাপের আগে ফিফার কর্মকর্তাদের মাথায় এসেছিল, বিশ্বকাপের জন্য আলাদা ও সম্পূর্ণ নতুন এক ম্যাচ বল বানানোর ভাবনা। ফিফার নির্দেশমতো রোমের ‘এন্তে সেন্ট্রালে আপ্রোভভিজিওনামেন্তো’ কোম্পানি বানিয়েছিল বিশ্বকাপের প্রথম অফিসিয়াল ম্যাচ বল ফেডেরালে ‘ওয়ান জিরো টু’। বলে থাকা ১৩ টি বহুভূজাকার প্যানেল হাতে সেলাই করা হয়েছিল। সেই প্রথম বিশ্বকাপের ম্যাচ বলে একটি আলাদা প্যানেল রাখা হয়েছিল লেস বাঁধার জন্য।
ফেডেরালে – ‘ওয়ান জিরো টু’
১৯৩৮
ফ্রান্স বিশ্বকাপের জন্য প্যারিসের অ্যালেন কোম্পানি বানিয়েছিল ম্যাচ বল ‘অ্যালেন’। টেকসই চামড়া দিয়ে তৈরি ১৩ প্যানেলের বলটি দেখতে ছিল, আগের বিশ্বকাপের ‘ফেডেরালে ওয়ান জিরো টু’ বলটির মতো। বলের গায়ে লেখা ছিল ‘কাপ ডু মন্ডে’ ও অ্যালেনের অফিশিয়াল শব্দগুলি।
অ্যালেন
১৯৫০
ব্রাজিল বিশ্বকাপের ম্যাচ বল বানিয়েছিল লুই পোল, অ্যান্তোনিও টোসিলিনি ও জুয়ান ভালবোনেসির ‘সুপারবল’ কোম্পানি। বলটির নাম ছিল ‘ডুপ্লো-টি’। সেবারই প্রথম লেস-মুক্ত বলে খেলা হয়েছিল বিশ্বকাপ। এবং সেবারই প্রথম ফুটবলে ব্যবহার করা হয়েছিল সিরিঞ্জ ভালব। বলের ভেতর ভরে দেওয়া হয়েছিল উন্নতমানের রবার দিয়ে তৈরি ব্লাডার।
ডুপ্লো-টি
১৯৫৪
বলের আকার ও ওজন নিয়ে বিশ্বকাপের দলগুলো বিভিন্ন অভিযোগ জানানোর জেরে, বিশ্বকাপে ব্যবহৃত বলের আকার, ওজন ও ব্যাস সরকারিভাবে বেঁধে দিয়েছিল ফিফা। ম্যাচ বল নির্মাতাদের ফিফা জানিয়েছিল, বলের পরিধি রাখতে হবে ৬৮-৭০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। এবং ওজন রাখতে হবে ৪১০-৪৫০ গ্রামের মধ্যে।
ফিফার নির্দেশ মেনে সুইজারল্যান্ডের কস্ট স্পোর্টস কোম্পানি বানিয়েছিল সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপের কমলা রঙের ম্যাচ বল সুইস ওয়ার্ল্ড চাম্পিয়ন। বিশ্বকাপে সেই প্রথম খেলা হয়েছিল ১৮ প্যানেলের বল। সেই প্রথম বলের ওপর বসানো হয়েছিল বলের নাম ও কোম্পানির লোগো।
সুইস ওয়ার্ল্ড চাম্পিয়ন
১৯৫৮
সুইডেন বিশ্বকাপের ম্যাচ বল বানিয়েছিল সুইডেনের সিডলাডের কোম্পানি। টপ স্টার নামের বলটিতে ছিল ২৪টি প্যানেল। ১০২ টি কোম্পানির পাঠানো বলের মধ্যে থেকে ফিফা বেছে নিয়েছিল টপ স্টার বলটিকে। বাদামি, কমলা ও সাদা রঙের টপ স্টার বলে খেলা হয়েছিল সেইবারের বিশ্বকাপ।
টপ স্টার
১৯৬২
চিলি বিশ্বকাপের ম্যাচ বল ক্র্যাক বানিয়েছিল ‘সেনর কাস্টোডিও জামোরা’ কোম্পানি। বলের নকশায় এসেছিল চমক। বলে ছিল ১৮ টি ষড়ভূজাকৃতি ও আয়তাকার প্যানেল। বলটির বহিরঙ্গে ছিল এক আজব ধাঁধা। কিন্তু সেবারের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ঘটেছিল বিপত্তি। চিলি-সুইজারল্যান্ড ম্যাচের রেফারি কেন অ্যাস্টন ভীষণ অখুশি ছিলেন ম্যাচ বল নিয়ে। ক্র্যাক বলটিতে প্রথমার্ধের খেলা হলেও দ্বিতীয়ার্ধ খেলানো হয়েছিল একটি ইউরোপিয়ান বল দিয়ে। ম্যাচ বল তৈরিতে অন্তর্ঘাতের গন্ধ পেয়ে ইউরোপিয়ান দল নাকি আয়োজক দেশ চিলির তৈরি করা বলে খেলতে চায়নি।
ম্যাচ বল ‘ক্র্যাক’
১৯৬৬
ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের ম্যাচ বল চ্যালেঞ্জ ফোর-স্টার বানিয়েছিল ব্রিটিশ কোম্পানি স্ল্যাজেঞ্জার। দুই ধরনের ম্যাচ বল বানিয়েছিল কোম্পানিটি। ১৮টি আয়তাকার প্যানেল সম্বলিত কমলা ম্যাচ বল ও ২৫ প্যানেলের লালচে বাদামি ম্যাচ বল।
চ্যালেঞ্জ ফোর-স্টার
১৯৭০
মেক্সিকো বিশ্বকাপে ঘটেছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। ম্যাচ বল তৈরি করেছিল জার্মানির ফুটবল বুট প্রস্তুতকারক কোম্পানি অ্যাডিডাস। অ্যাডলফ ড্যাশলারের অ্যাডিডাস অবশ্য ফুটবল বানাতে শুরু করেছিল ১৯৬৩ সাল থেকেই। ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে অ্যাডিডাসের তৈরি করা ফুটবল নির্বাচিত না হলেও, মেক্সিকো বিশ্বকাপে নির্বাচিত হয়েছিল অ্যাডিডাসের বল টেলস্টার।
সেই প্রথম বিশ্বকাপে এসেছিল ৩২ প্যানেলের সাদা কালো বল। ১২ টি কালো পঞ্চভূজ ও ২০ সাদা ষড়ভূজের প্যানেল দিয়ে তৈরি করা বলটি বানানোর সময় মাথায় রাখা হয়েছিল টিভির দর্শকদের কথা। সাদা কালো টিভিতে যাতে বলটিকে দর্শকেরা সহজে খুঁজে নিতে পারেন, তাই প্যানেলে আনা হয়েছিল সাদা ও কালো রঙ।
বলটিতে লেখা হয়েছিল অফিসিয়াল ওয়ার্ল্ড কাপ মেক্সিকো ১৯৭০ ও অ্যাডিডাস নামটি। বলটির নকশা করেছিলেন ডেনমার্কের জাতীয় দলের প্রাক্তন গোলকিপার এইজিল নিয়েলসেন। পরবর্তীকালে সাদা কালো প্যানেলের বলটি বিশ্বজয় করেছিল। অ্যাডিডাস পাকাপাকি ভাবে হয়ে গিয়েছিল ফিফার ম্যাচ বল প্রস্তুতকারী সংস্থা।
অ্যাডিডাসের তৈরি বিশ্বকাপ বল টেলস্টার
১৯৭৪
পশ্চিম জার্মানি বিশ্বকাপের জন্য ফিফা বেছে নিয়েছিল এজিল নিয়েলসেনের নকশা করা ও অ্যাডিডাসের তৈরি করা ৩২ প্যানেলের জলনিরোধক বল টেলস্টার ডুরলাস্ট। সেই প্রথম বিশ্বকাপে ব্যবহৃত হয়েছিল চামড়ার উপর পলিইউরেথিনের প্রলেপ দেওয়া বল। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজলেও যে বলের আকার নষ্ট হবে না। এই বিশ্বকাপে অ্যাডিডাসের বানানো চিলি ডুরলাস্ট বলেও কিছু ম্যাচ হয়েছিল। জার্মানির বিশ্বকাপের ম্যাচ বল বানানো হয়েছিল অ্যাডিডাসের ফ্রান্সের কারখানায়।
টেলস্টার ডুরলাস্ট
১৯৭৮
আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে অ্যাডিডাস এনেছিল নতুন ম্যাচ বল ট্যাঙ্গো। এই বলটিতে কমানো হয়েছিল প্যানেলের সংখ্যা। ২০টি প্যানেলের সেই বলের গায়ে ফুটিয়ে তুলেছিল ১২ টি সমান আকারের বৃত্ত।
ট্যাঙ্গো
এসটি/এফএইচ