নেইমার গত এক দশকে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় তারকা। ব্রাজিল- পাঁচবারের বিশ্বকাপ জয়ী দল, যাদের ফেডারেশন লোগোর পাশে পাঁচ তারকা আঁকা। ব্রাজিলে যত বড় তারকাই আসুক না কেন, বিশ্বকাপ না জেতাতে পারলে সেখানে কোনও ফুটবলারের নাম লোকে মনে রাখবে না।
বলা হয়ে থাকে ব্রাজিলের সবচেয়ে প্রতিভাবান এক ঝাঁক ফুটবলার বিশ্বকাপ জিততে ব্যর্থ হয়েছিলেন। জিকো, সক্রেটিস, ফ্যালকাওদের ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দল। সেই ব্রাজিল দলকেই ভুলিয়ে দিয়েছেন রোমারিও ১৯৯৪ সালে, রোনালদো ২০০২ সালে।
বিজ্ঞাপন
ইতিহাস তাদের প্রতিভাবান হিসেবে মনে রেখেছে, কিন্তু জয়ী দলের ফুটবলার হিসেবে নয়। নেইমারের প্রতি ব্রাজিলিয়ানদের প্রত্যাশা, তিনি অন্তত একটা বিশ্বকাপ জেতাবেন। সান্তোস থেকে বার্সেলোনায় যাওয়ার সময় নেইমারের ভিডিওতে সয়লাব ছিল ইউটিউব, বল নিয়ে নানান ক্যারিকেচার, নানান ভঙ্গিতে বলকে বশ মানাতেন নেইমার।
কারও মনে ডাক দিয়েছিল পেলের নাম, কারও নিকটতর অতীতের রোনালদিনহো। নেইমার নিজের মতো করে এগিয়েছেন, কখনো লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর সাথে তার নাম এসেছে ঠিক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ছাপিয়ে যেতে পারেননি।
বরং নেইমারকে ছাপিয়ে গেছেন অন্যরা, ২০১৮ বিশ্বকাপে যেমন কিলিয়ান এমবাপে। ক্লাব ফুটবলে রবার্ট লেওয়ান্ডভস্কি। নেইমার বার্সেলোনা ছাড়ার পরে আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জিততে পারেননি। এর মধ্যে ব্রাজিল একবার কোপা আমেরিকা জিতেছিল, কিন্তু সেই স্কোয়াডে ছিলেন না নেইমার, চোটের কারণে।
চোটের কারণে তিনি ২০১৪ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলতে পারেননি। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে আলোচিত ম্যাচগুলোর একটি ছিল জার্মানির বিপক্ষে সেই সেমিফাইনাল- যাতে ৭-১ গোলে হেরেছিল ব্রাজিল- এবং সেটা ব্রাজিলের মাটিতেই।
বিজ্ঞাপন
১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের নায়ক ছিলেন রোমারিও, তিনি নেইমারকে উদ্দেশ্য করে প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে একটা লেখা লিখেছেন। যেখানে তিনি বলেছেন, 'নেইমারকে অনেকে অনেক উপদেশ দিতে আসে কিন্তু আমি বলবো নেইমার, তুমি নিজের মতো খেলো।'
নেইমারকে রোমারিও মনে করেন 'পাগলাটে একজন ফুটবলার। নেইমারকে বলবো, তুমি নিজের মতোই থাকো। তুমি যেমন সেটাই থাকো। কিছু মানুষ তোমার সমালোচনা করবেই। মিডিয়া, সমর্থকরা এমনকি প্রতিপক্ষ তখনই তোমার প্রশংসা করবে যখন তুমি নিজের কাছে সৎ থাকবে।'
নেইমার এমন একজন চরিত্র যিনি প্রায়শই মাঠের বাইরের নানা ঘটনা নিয়ে আলোচনায় থাকেন। বার্সেলোনা ছেড়েছেন প্রায় অর্ধযুগ হতে চলেছে, এখনও তিনি সেই সান্তোস থেকে বার্সেলোনায় যাওয়ার দলবদলে জালিয়াতির মামলায় কোর্টে হাজিরা দেন। যদিও প্রসিকিউটররা তাকে এই জালিয়াতি মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
এর আগে একবার ধর্ষণ মামলাতেও অভিযুক্ত হয়েছিলেন নেইমার, সেখান থেকেই তাকে দোষী প্রমাণিত করা যায়নি ঠিক, কিন্তু অভিযোগটাই এতো বড় যে নেইমারের মতো তারকার নামে কালিমা লেপনের জন্য এটা যথেষ্ট।
সাতবারের ব্যালন ডি অর জয়ী লিওনেল মেসির সবচেয়ে প্রিয় ফুটবলারদের একজন নেইমার। বার্সেলোনায় যখন একসাথে খেলতেন তখনই দুজনের সখ্য ছিল দেখার মতো। মেসি একটি সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি বলেছেন, 'নেইমার বিশ্বের অন্যতম সেরা। আমি ওর জবাব দেয়া দেখতে মুখিয়ে আছি।'
কিন্তু নেইমার এখনো ব্যালন ডি অর জেতেননি। লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর যুগে নেইমারের নাম প্রায়ই তিন নম্বরে এসেছে।
তিনি প্রমাণ দিয়েছেনও বটে, যেমন ২০১৫ ও ২০১৭ সালের ব্যালন ডি অর নমিনেশন তালিকায় সেরা তিনে ছিলেন নেইমার। কিন্তু নেইমার দিন শেষে দ্বিতীয় রানার আপ। আসলেই কি তিনি তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন?
২০১৩ সালে বার্সেলোনায় যোগ দেয়ার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছে ফুটবল বিশ্লেষক ওয়েবসাইট দ্য অ্যানালিস্ট। যেখানে এসেছে নেইমার ২৫ জন ফুটবলারের একটি তালিকায় আছেন যেখানে সবাই অন্তত ১০০ গোল করেছেন ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে খেলে। কিন্তু নেইমার এখানে পিছিয়ে আছেন অনেক।
নেইমার তার প্রত্যাশিত গোল করতে পারেননি। এই প্রত্যাশিত গোলের তালিকায় এগিয়ে ছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, হ্যারি কেইন, লুইস সুয়ারেজ, লিওনেল মেসি।
পিছিয়ে ছিলেন এডিন জেকো, ফ্যাবিও কুয়াগলিয়ারেয়া ও নেইমার। নেইমার ইউরোপে এখন নবম মৌসুমে খেলছেন। ২০১৭-১৮ মৌসুম থেকে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ে খেলছেন নেইমার।
তিনি ২০২১ সাল পর্যন্ত গোল করেছেন ৫৩টি। একই সময়ে কিলিয়াম এমবাপের লিগ গোল ছিল ৮৯টি, মেমফিস ডিপে করেছিলেন ৫৬ গোল। নেইমার তৃতীয় এখানে, অনেক ফুটবলারের চেয়ে ভালো।
কিন্তু যখন বিশ্বের সেরা তারকাদের একজন নেইমারের কথা বলা হয়, ফরাসী লিগে তার গোলসংখ্যা আরও বেশি হওয়া উচিৎ ছিল বলেই মনে করে, দ্য অ্যানালিস্ট। তবে নেইমারকে ফাউলও করা হয়েছে অনেক।
দ্য অ্যানালিস্টের বিশ্লেষণ বলছে, ২০১৭-১৮ মৌসুম থেকে লিগ ওয়ানের ম্যাচে নেইমারকে ২২৭ বার ফাউল করা হয়েছে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১২৮ বার। দুটি প্রতিযোগিতাতেই এটা সর্বোচ্চ, প্রতি ১৯ মিনিটে নেইমারকে একবার ফাউল করা হয়েছে।
নেইমার তার প্রত্যাশিত গেমটাইম খেলতে পারেননি যে কারণে, পিএসজিতে তাকে প্রতি ১০০ মিনিটের মধ্যে ৪৫ মিনিট মাঠে পাওয়া গেছে। কাতারে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন নেইমার। গোটা ক্যারিয়ার হিসেব করলে, তার যে পরিমাণ সময় মাঠে থাকার কথা তার মাত্র ৬০ শতাংশ সময় তিনি মাঠে থেকেছেন।
বাকি সময় নানা ধরনের চোটে ভুগেছেন নেইমার। প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ে ২০১৭-১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নেইমার ৫৬০২ মিনিট মাঠে ছিলেন। যেখানে মেসি ও রোনালদো ২০২০-২১ মৌসুমের শুরু থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত যথাক্রমে ৫৪৫৩ মিনিট ও ৫৩৮২ মিনিট মাঠে ছিলেন।
দ্য অ্যানালিস্ট বলছে, 'এই পরিসংখ্যান শংকার বটে, এই শংকাটা আরও বেড়ে যায় যখন আপনি দেখেন নেইমারের বয়স ২৯, মেসির ৩৫ এবং রোনালদোর ৩৭।'
অথচ ক্যারিয়ার জুড়ে নেইমারের প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল অঢেল। সেই প্রাপ্তির হিসেব এবারে মিলবে? ব্রাজিল এবার এমন এক আক্রমণভাগ নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গেছে, যারা ইউরোপ মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এখানে নেইমারের ওপর আলাদা স্পটলাইট কম। আর্সেনালে দুর্দান্ত ফর্মে আছেন গ্যাব্রিয়েল জেসাস, লন্ডনের আরেক ক্লাব টটেন্যামে এসেই মাতিয়ে তুলেছেন রিচার্লিসন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী দুই ফরোয়ার্ড ভিনিসিয়াস ও রদ্রিগো আছেন, সাথে আছেন বার্সেলোনার রাফিনিয়া।
বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট জিততে ম্যাচ উইনারের প্রয়োজন হয়, ব্রাজিল দলে এখন একের পর এক ম্যাচ উইনার। যারা নিজ নিজ ক্লাবে নায়ক এখন সময় ব্রাজিলের হয়ে জ্বলে ওঠার।
সূত্র: বিবিসি
একে