‘মরুর জাহাজ’ পরিচিত উটটি বন্ধুর মতো পিঠে বয়ে নিয়ে চলছে তার স্বপ্নকে। তপ্ত মরু বুকে বয়ে ছুটে চলেছে বেদুইন। সেখানে একফোঁটা পানির মূল্য অনেক—যেন কারবালার অনুভূতি। ধু-ধু মরুভূমিতে ফাঁকা ফাঁকা খেজুর গাছের সারি। সেখানে ছোট জলাশয়ে অল্প পানি। এতেই বেঁচে থাকার উৎস খুঁজে পান বেদুইনরা।
হাজার বছর আগে সেই বাস্তবতা ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে অনুভব করেছে কাতার। শুরু থেকে এই আয়োজন নিয়ে তোপের মুখে পড়ে তারা। আলোচনা আছে, সমালোচনাও কম নয়। কাতারে যেসব হোটেলে সমর্থকরা অবস্থান করবেন, বা যে স্টেডিয়ামে খেলা দেখবেন, হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিক কয়েক বছর ধরে সেগুলো তৈরি করেছেন। তবে, এসব শ্রমিকদের সঙ্গে কাতারের আচরণ বৈরি।
বিজ্ঞাপন
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বলছে, বিশ্বকাপ আয়োজনের বিডে জয়ী হওয়ার পর থেকে ৬ হাজার ৫ শত অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছেন। এসব শ্রমিকের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তানের নাগরিক রয়েছে। তবে, কাতার সরকার বলছে মৃত্যুর এ হিসাব বিভ্রান্তিকর। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এরকম একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) বলছে, কাতার সরকার মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে বলছে।
বিশ্বকাপের ইতিহাসের কাতার একটি নতুন দেশ। আলোচনা-সমালোচনা যাই থাকুক, ছোট দেশ বড় স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিন। ছোট শহর দোহা। ৮টি স্টেডিয়ামে তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে অনেক বাধা, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে দেশটিকে। সেই বাধা উতরিয়ে তাদের দেশে উড়তে যাচ্ছে বিশ্বকাপের নিশান। ফুটবলের সবচেয়ে বড় আয়োজন ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’।
ফুটবলের এই মহাযজ্ঞে ৩২টি দেশ লড়াইয়ে নামবে। কিন্তু ‘বিশ্বকাপের বাঁশি’ কে বাজাবে, ‘শেষ হাসি’ কে দিবে—এরকম প্রশ্ন সাধারণ-অসাধারণ কিংবা ছোট-বড় সব ফুটবল বোদ্ধাদের মনে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে ১৮ ডিসেম্বর।
বিজ্ঞাপন
বিশ্বকাপ উন্মাদনায় পুরো বিশ্ব
কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। সাধারণ মানুষের ভেতরে এসব বিতর্ক সাময়িক খোরাক জোগালেও সবার চোখ বিশ্বকাপের দিকে, আর প্রিয় দল নিয়ে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা জানি না, তবে বাংলাদেশে ছুঁয়ে গেছে বিশ্বকাপের উন্মাদনা। নগর-শহর—গ্রামে-গঞ্জ—সবখানে চলছে উৎসবের আমেজ। দোকানগুলোতে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে। ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা কোন পর্যায়ে, দেশের প্রত্যেকের মধ্যে এ আবেগ লুকিয়ে আছে। ঢাকায় বিভিন্ন দোকানে দোকানে জার্সি বিক্রির ধুম, পতাকা বিক্রির হিড়িক চলছে।
সমর্থকদের উচ্ছ্বাস
বাংলাদেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকই বেশি। আবাহনী ও মোহামেডান যেমন দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়, তেমনই বিশ্বকাপ এলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে রেষারেষি দেখা যায়। পাড়ায় পাড়ায় পতাকা টাঙিয়ে রাখা হয়। কোথাও আবার বিশ্বকাপের আগে ভাল অনুষ্ঠান হয়। তবে, এখন জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল এমনকি ইংল্যান্ডের সমর্থকও তৈরি হয়েছে। দুঃখজনক এবার টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে পারছে না তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ান দল ইতালি। সমর্থকদের জন্য এটা সবচেয়ে বড় কষ্টদায়ক ব্যাপার।
জামালপুরে আর্জেন্টিনা জিতলে ৫টি গরু খাওয়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, একই জেলায় ব্রাজিল সমর্থকরা বলছে কাপ জিতলে ১০টি গরু খাওয়াবেন। এ-রকম অসংখ্য উন্মাদনা তো রয়েছে। বাড়ি সাজানো, গ্রামজুড়ে পতাকা প্রদর্শন চলছেই। আবার প্রেথিডিক ব্যাপার হলো, প্রিয় দলের পতাকা টাঙাতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে, ছাদ থেকে পড়ে কিংবা বিদ্যুতায়িত হয়ে কেউ কেউ মারা গেছেন। বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু এ মানুষগুলো স্বজনদের কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে।
সব বিতর্ক আর বিষাদকে সঙ্গী করেও কাতারে এখন সাজ সাজ রব। ফুটবলের সব মহাতারকাদের মেলা কাতারকে করে তুলেছে আরও বর্ণিল ও ঝলমলে। শুধু কাতার নয়, পুরো দুনিয়াটা এখন বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে। এটা কেবল বলার জন্য বলা নয়, প্রশ্ন। বিশ্বকাপ শুধুমাত্র ফুটবলেই আবদ্ধ থাকে না। এ এক উৎসব। বাতাসে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে নানা কৌতূহলী ঝড়।
ফুটবলের মহাতারকারা পারবে কি শেষ বিশ্বকাপ রাঙাতে?
মেসি কি পারবেন আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অক্ষেপ ঘোচাতে, নাকি বিশ্বকাপ ট্রফি জিতে সমালোচকদের জবাব দেবেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো? নেইমার কি পারবেন তার অপ্রাপ্তি ঘুচাতে, না ফুটবল মঞ্চে আবারও উড়বে জার্মান পতাকা? ফ্রান্স কি এবার চ্যাম্পিয়নদের দুর্ভাগের ধারা বদলাতে পারবে, নাকি ক্রোয়েশিয়ার মতো আবার নতুন কেউ চমক নিয়ে হাজির হবে? সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে ১৮ ডিসেম্বর। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
ব্রাজিল এবারের অন্যতম দাবিদার। নেইমার ডা সিলভা স্যান্টোস জুনিয়রের ওপরে খুব একটা নির্ভরশীল নয় তারা। ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রাফিনহা অথবা অ্যান্টনির মতো উইঙ্গার দলে থাকলে আর চিন্তা কীসের? স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে পারে রিচার্লিসন। নেইমার সে ক্ষেত্রে অ্যাটাকিং মিডিয়ো হিসেবে খেলবে। ব্রাজিলের স্ট্রাইকিং লাইনের গতির সঙ্গে আর কোনও দল মানিয়ে নিতে পারবে কি না জানা নেই। মাঝ মাঠে খেলবে ফ্রেড, কাসেমিরো ও লুকাস পাকেতা। শুধুমাত্র দুটি সাইড-ব্যাক নিয়ে ব্রাজিলকে ভাবতে হতে পারে। দানি আলভেসের ৩৯ বছর বয়স। তার উপরে কি ব্রাজিল এখনও নির্ভর করবে?
মেসি, আর্জেন্টিনার এক বাঁ-পায়ের জাদুকর। তার খেলা দেখে মনে হয় না জোর করে কিছু করছে। ডান-প্রান্ত থেকে কাট করে ভিতরে ঢোকা থেকে মাঝমাঠ থেকে সতীর্থের জন্য গোলের ঠিকানা লেখা পাস, সবই ওর নখদর্পণে। ২০১৪ সালে মেসির খেলা দেখে মনে হয়েছিল বিশ্বকাপ এবার আর্জেন্টিনাতেই যাচ্ছে। কিন্তু কে ভেবেছিল হিগুয়াইন গোলের সামনে থেকে বল বাইরে মারবে? জার্মানির মারিয়ো গোৎজ়ে সেই ভুল করেনি। একটাই সুযোগ পেয়ে জালে বল জড়িয়ে দেয়। মেসির সেই অশ্রুভরা চোখ যে কোনও ফুটবলপ্রেমীকে কাঁদিয়ে দিতে পারে। তার সামনে এবার শেষ সুযোগ।
দল হিসেবে আর্জেন্টিনা সবচেয়ে শক্তিশালী। রক্ষণভাগ নিয়েই এত দিন মূল চিন্তা ছিল আর্জেন্টিনার। আর্জেন্টিনা এখন আর আগের মতো বল পায়ে রাখে না। পজিশন ফুটবলের চেয়েও বেশি প্রতিআক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে। রদ্রিগোর গতি ও লম্বা পাসের উপরেই নির্ভর করে ওদের প্রতিআক্রমণ। মেসি অ্যাটাকিং মিডিয়োর কাজটি করে। তিনি হচ্ছেন স্ট্রাইকিং লাইন ও মাঝ মাঠের সেতু। বিপক্ষের রক্ষণের ফুটবলারদের বিভ্রান্ত করার কাজ ফুটবল সম্রাটের। আর্জেন্টিনা দল ভাল হলেও গ্রুপ পর্বে তাদের পরীক্ষা খুব একটা সহজ নয়।
মেসির মতোই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোরও এটা শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু পর্তুগালকে নিয়ে আমার আর কোনও আশা নেই। রোনালদো বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। খুব একটা ছন্দেও নেই। ব্রুনো ফের্নান্দেজ ও বের্নার্দো সিলভার উপরে নির্ভর করছে দলের খেলা। যেদিন তারা ব্যর্থ হবে, পর্তুগালের সূর্যও ডুবে যাবে।
এবারের বিশ্বকাপে ফ্রান্স অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। জামার্নিকে বিশ্বকাপের বাইরে রাখা যাবে না। ইংল্যান্ড ইউরোর ফাইনাল খেলেছে। স্পেন ভালো খেলেছে। ভালো খেলেছে পর্তুগালও। আর্জেন্টিনাও এবারের আসরে অন্যতম ফেবারিট। ৯০ মিনিটের লড়াইয়ের শেষ দুই মিনিটেও বলা যাবে না খেলা কোনদিকে গড়াচ্ছে।
কোন দল দিতে পারে শেষ হাসি?
ক্রিকেটের এক কিংবদন্তী ভিভ রিচার্ডসের ভাষায়—‘কোনো দলীয় খেলাতেই কেউ একা শিরোপা জেতাতে পারে না, যদি না আপনার নাম হয় ডিয়েগো ম্যারাডোনা’। তার এ কথার রেশ ধরে বলা যায়, ‘অ্যা টিম’ হিসেবে খেলে, যেকোনো ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দলের একটা হালকা উপলক্ষ্য মাত্র। ব্রাজিল যারা সমর্থন করে তারা মূলত ফুটবলের শৈল্পিক আর ঐতিহ্যের সাম্বা ফুটবলকেই ভালবাসে। নেইমার বা অন্যকোনো খেলোয়াড় সেখানে গৌন। এটা কেবল ব্রাজিলের ক্ষেত্রে নয়, সব দলের ক্ষেত্রে বলা।
ইউরোপ সবসময় এগারজন এ বিশ্বাসী। লাতিন আমেরিকাও কাগজে-কলমে তা-ই, কিন্তু মনে মনে সবাই মেসি-নেইমার! ইউরোপ ও ল্যাতিন আমেরিকার লড়াইয়ে তাই এই কথাই বলা যায়, এই দুই অঞ্চল মানেই দলীয় খেলা বনাম ব্যক্তিগত ঝলক। এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ কম। কেন না এর বাইরে অন্য কোনো দেশ বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। দেখা যাক কে বাজাতে পারে বিশ্বকাপের বাঁশি, কোন দল দিতে পারে শেষ হাসি?
এমএএম