আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। এরপরই পর্দা উঠছে ফিফা বিশ্বকাপ-২০২২ এর। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে প্রথমবারের মত বসতে যাচ্ছে ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই আসর। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হয়ে ফুটবল বিশ্বকাপ এখন পর্যন্ত মাঠে গড়িয়েছে ২১ বার। এরমধ্যে ১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ছিল রোমাঞ্চে ভরপুর। জেনে নেওয়া যাক, লাতিন আমেরিকার দেশটিতে হওয়া আলোচিত-সমালোচিত বিশ্বকাপের নানান কথা।
বিশ্বকাপের ১১তম আসর। ১৯৭৮ সালের ১ থেকে ২৫ জুন, ২৪ দিনের মহাযজ্ঞ বসেছিল আর্জেন্টিনায়। ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিকরা। নিজেদের ইতিহাসে প্রথম এবং সবমিলিয়ে পঞ্চম দল (উরুগুয়ে, ইতালি, ইংল্যান্ড,পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স) হিসাবে ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়ন হয় আলবিসেলেস্তারা।
বিজ্ঞাপন
টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয় তিউনিসিয়া ও ইরান। এই আসরের মধ্যদিয়ে শেষ হয় ১৬ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন। যাতে আয়োজক দেশ বাছাইপর্ব ছাড়াই সরাসরি বিশ্বকাপ খেলে। পরের আসরগুলোতে ২৪ দল অংশগ্রহণ করে। এখন যেটা ৩২ দলে এসে ঠেকেছে।
আরও পড়ুন: সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিশ্বকাপের পেছনের গল্প
এই বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ছিল নাটকীয়তা। ইতালি ও নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে কোয়ালিফাই থেকে বাদ যায় ইংল্যান্ড ও বেলজিয়াম। এছাড়া ১৯৭৬ সালের ইউরোপ সেরা চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নও বাছাইপর্ব পার হতে পারেনি।
তবে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পাওয়া পর থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। বিতর্কিত বিশ্বকাপগুলোর মধ্য অন্যতম ছিল এই ৭৮’র বিশ্বকাপ।
বিজ্ঞাপন

সাধারণত কোনো দেশে বিশ্বকাপ হলে তা কমপক্ষে ৫ বছর আগেই ঠিক হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালের আগেই ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশের দায়িত্ব পায় আর্জেন্টিনা। এসময়ই আবার (১৯৭৬ সালে) আর্জেন্টিনায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়, ক্ষমতায় আসে ভিদেলের জান্তা সরকার। দেশে শুরু হয় অরাজকতা। চিরাচরিতভাবেই জান্তা সরকার দেশে চালায় হত্যা, গুমসহ নানা অত্যাচার। এমনকি ভিন্নমতাবলম্বীদের ব্যাপকহারে গুম করে দেয়া হয়। রাতারাতি নিখোঁজ হন সাড়ে ৫ হাজারের বেশি মানুষ।
জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসায় নেদারল্যান্ডসের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশ বিশ্বকাপ স্থানান্তরের ব্যাপারে মতামত জানায়। কিন্তু একটি বিশ্বকাপ সরিয়ে নেয়া এত সহজ ব্যাপার না, তাই বিশ্বকাপ আয়োজন আর্জেন্টিনাতেই থেকে যায়।
আরও পড়ুন: কন্টেইনার দিয়ে নির্মিত স্টেডিয়ামে খেলবেন মেসি-নেইমাররা
তাতে সব দল আসলেও বিশ্বকাপ বয়কট করেন ডাচ কিংবদন্তি, সেই আমলের সেরা ফুটবলার ইয়োহান ক্রুইফ ও জার্মান তারকা ডিফেন্ডার পল ব্রিটনার। মুখে অন্য পারিবারিক কারণ দেখালেও, ক্রুইফের অনেক কাছের লোকের ভাষ্যমতে সিদ্ধান্ত ছিল জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ।
অপরদিকে টুর্নামেন্ট শুরুর কিছুদিন আগে আয়োজক কমিটির প্রধানকে হত্যা করে জান্তা সরকার। কারণ তিনি নাকি অতিরিক্ত ব্যয়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে যাচ্ছিলেন। সেই বিশ্বকাপ স্মরণ করিয়ে দেয় হিটলার আমলের ১৯৩৬ অলিম্পিক ও ১৯৩৪-এ মুসোলিনির ইতালি বিশ্বকাপের কথা।
লাতিন আরো কিছু সাময়িকীতে আসে আরও গুজব। আর্জেন্টিনার জেলে বন্দি ১৩ জন পেরুভিয়ান নাগরিককে মুক্তি দেয়ার বদলে দ্বিতীয় রাউন্ডে জয়টি দাবি করে জান্তা সরকার। অভিযোগ ওঠে, চুক্তি হয়েছিল আর্জেন্টিনার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা পেরুর বিদেশি অর্থ নিয়েও। বিতর্ক ছিল তখনকার ১৭ বছরের উঠতি তারকা ম্যারাডোনাকে দলে না নেয়া নিয়েও। তবে এসব কোনো বিতর্কেরই প্রমাণ পাওয়া যায়নি শেষঅবধি।

শুরু থেকে চলা বিতর্ক জারি থাকে শেষেও। ফাইনালে নেদারল্যান্ডস দলকে স্টেডিয়ামে আনা হয় অনেকবেশি পথ ঘুরিয়ে। মাঠের মধ্যে যখন হল্যান্ড দলকে নামানো হয়, তখনও আর্জেন্টিনা দল ড্রেসিংরুমে। কেন এটা করা হয়েছিল? লাতিন সমর্থকরা অন্যান্য যেকোনো জায়গার থেকেই বেশি ফুটবল আবেগময়, তাই স্টেডিয়ামও থাকে বেশি শোরগোলময়। বুয়েন্স আয়ার্সের ৭০ হাজার সমর্থকের সামনে ডাচ দলকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল কেবল দুয়ো শোনার জন্য। ৭০ হাজার দর্শক হুইসেল ফুঁকিয়ে, সিটি বাজিয়ে নেদারল্যান্ডস দলকে দুয়ো দিতে থাকে খেলা গড়ানোর আগ পর্যন্ত।
এই বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা ও পেরুর এই ম্যাচটি ছিল ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়গুলোর একটি। জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল পেরুর ১৩ জন নাগরিককে। তাদের মুক্তির বিনিময়ে পেরু ম্যাচটি হেরে যায়।
ইতিহাসে এই শিরোপাটি আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা হলেও এটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার কালো অধ্যায়ের জন্য।
এসটি/এমএএম































































































































































































































































































































































































































































