ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ঝালকাঠির বিভিন্ন হাটে কোরবানির পশু উঠতে শুরু করলেও ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই নগন্য। সামনে আরও কয়েকদিন বাকি থাকায় ভারতীয় গরু এলে দাম কমার অপেক্ষায়, অপরদিকে বসন্ত রোগে আক্রমণের আশঙ্কায় কুরবানির জন্য পশু কিনে লালন পালন করে যথাসময়ে কোরবানি দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না ক্রেতারা। এজন্য হাটে গরু উঠলেও ক্রেতারা ঘুরেফিরে দেখে দাম যাচাই করেন। কিন্তু কিনতে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
কোররবানি উপলক্ষে অস্থায়ী পশুর হাটের অনুমোদনের জন্য ২৭টি আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৭টিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। বাকি আবেদনগুলোর মধ্যে গুরুত্ব যাচাই করে অনুমোদন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের এনডিসি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিলন চাকমা।
বিজ্ঞাপন
সূত্রটি জানায়, ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৭টি অস্থায়ী কুরবানির পশুর হাটের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জেলার ৪টি উপজেলায় প্রচলিত বিদ্যমান ৮৬টি হাটবাজারের মধ্যে নতুন এই ১৭টি অস্থায়ী পশুর হাট বসছে। সর্বাধিক রাজাপুর উপজেলায় ৭টি, ঝালকাঠিতে সদরে ৫টি, নলছিটি ৩টি ও কাঠালিয়ায় ২টি পশুর হাট বসছে। ঝালকাঠি সদরে জেলা পরিষদের বিপরীতে ১টি, শেখেরহাট ইউনিয়নের শিরযুগ গ্রামে ১টি, কৃত্তিপাশা মোড় এলাকায় ১টি ও বিকনা স্টেডিয়াম সংলগ্ন ১টি পশুর হাটের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
রাজাপুর উপজেলায় পুটিয়াখালী, মিরেরহাট, আমতলা বাজার, গালুয়া এলাকা, নিজামিয়া বাজার এলাকায়, গাজীর হাট এলাকায় ও তুলাতলা গ্রামে ১টি করে অস্থায়ী হাটের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
নলছিটি উপজেলা সদরে চায়না মাঠ, মুখিয়া বাজার ও টেকের হাটে ১টি করে এবং কাঠালিয়া উপজেলার আমুয়া বাজার সংলগ্ন ও বলতলা গ্রামে ১টি করে হাট বসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতীয় গরু আমদানি ও বসন্ত রোগ নিয়ে ডাবল দুশ্চিন্তায় ভুগছেন খামারিরা। শুধু খামারিরা না, কোরবানির পশুর ক্রেতারাও ভাবনাতে আছে এ দুটি বিষয় নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
খামার মালিকরা জানিয়েছেন, খাদ্য, ওষুধ ও বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে গত বছরের তুলনায় এবার পশুর দাম চড়া যাবে। তবে ভারতীয় গরু আমদানি না করা হলে খামারি ও কৃষকরা লাভের মুখ দেখবেন। অপরদিকে অনেক জায়গায় গরুর দেহে বসন্ত রোগ দেখা দেওয়ায় আতঙ্কে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন খামার মালিকরা। ঝালকাঠি জেলায় এবার কোরবানির জন্য প্রায় ১৯ হাজার পশু প্রস্তুত রয়েছে।
ঝালকাঠিতে কোরবানি উপলক্ষে বাণিজ্যিকভাবে খামার না থাকলেও পারিবারিক এসব পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব পশুর মধ্যে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রাকৃতিক উপায়ে কাঁচা ঘাস, খড়, বিভিন্ন প্রকারের ভূষি, ডালের গুঁড়া, ভাত, ভাতের মাড়, খৈল ও কিছু ভিটামিন খাইয়ে মোটাতাজা করণে ব্যস্ত সময় পার করছে পারিবারিক খামারিরা। বাড়তি লাভের আশায় বাড়িতে বাড়িতে পশুর বাড়তি যত্ন আর লালন পালনে নারী-পুরুষ মিলে ব্যস্ত সময় পার করছেন পারিবারিক খামারি পরিবারগুলোতে।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানায়, ঝালকাঠি জেলা কুরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে ১৮ হাজার ১২১টি। কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে ১৮ হাজার ৮৬২টি। এসব গবাদি পশুর মধ্যে ষাড় ৮ হাজার ১১১টি, বলদ ৩ হাজার ২৩১টি, গাভী ২ হাজার ১৩৮টি, মহিষ ৩৭টি, ছাগল ৫ হাজার ২৯৬টি, ১৭টি ভেড়া কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে পারিবারিক খামারি রয়েছে ৩ হাজারেরও বেশি। কোরবানির জন্য ১৮ হাজার ১২১টি পশুর চাহিদা থাকলেও প্রস্তুত রয়েছে ১৮ হাজার ৮৬২টি। উদ্বৃত্ত ৭৪১টি স্থানীয় বিভিন্ন হাটের চাহিদা পুরণ করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন ঝালকাঠি প্রাণিসম্পদ কর্তৃপক্ষ।
এদিকে বেড়েই চলছে গো-খাদ্যের দাম। পারিবারিক খামারিদের এখন প্রতিদিন গো-খাদ্যে খরচ বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে গরু আমদানি করলে ন্যায্য মূল্যে গরু বিক্রি করতে না পারলে খামারিদের লোকসান গুনতে হবে অনেক। কৃষক ও খামারিরা জানিয়েছেন, কেউ বাড়ির গোয়ালে আবার কেউ পারিবারিক খামারে এসব পশু মোটাতাজা করছেন। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাস খাইয়ে পশু মোটাতাজা করছেন তারা। খড়ের পাশাপাশি খৈল, গমের ভুষি, ভুট্টার গুড়া, ধানের কুঁড়া, মুগের ভুসি, খড় ও বুটের খোসা খাওয়ান অনেকে। জেলার ছোট-বড় পারিবারিক পশুর খামারে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আসছে কোরবানির ঈদে এসব পশু বিক্রি করে বাড়তি আয়ের আশা করছেন তারা। তবে ভারতীয় গরু আমদানি এবং পশুর দেহে বসন্ত রোগে আক্রমণ করলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে খামারিদের।
সদর উপজেলার দারাখান গ্রামের ওয়ালিউর রহমান বলেন, তার পারিবারিক খামারে দেশি-বিদেশি মিলে ১০টি ষাঁড় মোটাতাজা করা হচ্ছে। এ খামারে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের পশু আছে। সদর উপজেলার ডুমুরিয়া এলাকার কঙ্কন ব্যাপারী জানান, ১২টি গরু নিয়ে তিনি পারিবারিক খামার গড়ে তুলেছেন। এরমধ্যে ৪টি দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভী এবং কোরবানিতে বিক্রির জন্য ৫টি বলদ রয়েছে। বাকিগুলো বিক্রির অনুপযোগী। তবে যে পরিমাণে গো খাদ্যের দাম তাতে খরচ পুষিয়ে লাভ করাটা খুবই কষ্ট সাধ্য। পারিবারিক খামার পরিচালনাকারী সুজন সরকার বলেন, গো-খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ৩৭ কেজি ওজনের এক বস্ত গমের ভুষির বর্তমান বাজার মূল্য ২ হাজার ২০০ টাকা, পুর্বে ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা। ৭৪ কেজির এক বস্তা খৈল এখন ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, গত বছর ছিল ২ হাজার ৮০০ টাকা। ৫০ কেজি ধানের কুঁড়ার দাম ৯০০ টাকা, গত বছর ছিল ৭০০ টাকা। প্রতি কেজি খড় এখন ১৫ টাকা, আগে ছিল ১০ টাকা। এছাড়া খেসারি ও ছোলার ভুষির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। গত কয়েক বছরে ৭ থেকে ৮ দফা গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে। বছরখানেক ধরে কষ্ট করে গরু কোরবানিতে বিক্রির উপযোগী করেছি। ভালো একটা লাভ পাবো আশা করে এরমাধ্যমে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে। কিন্তু দুশ্চিন্তা হলো যদি ভারতীয় গরু দেশে ঢুকে তাহলে আমাদের পশুর দাম কমে যাবে। কাঙ্খিত দামে বিক্রি করতে পারব না। আবার অনেকের পশুর গায়ে বসন্ত রোগ দেখা দিয়েছে। কুরবানিতে বিক্রির উপযোগী পশুর দেহে যদি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তো আমাদের চেষ্টা, আশা, ভরসা, পরিকল্পনা সবই শেষ হয়ে যাবে। অন্যান্য পশু চাষিরা বলেন, শ্রমিকদের দুই বছর আগে বেতন ছিল প্রতিদিন ৫০০ টাকা। এখন প্রতিদিন ৭৫০ টাকা কাজ করাতে হচ্ছে। পশু পালনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে কেউ খামার করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। পাশাপাশি ব্যাংক ও এনজিওর ঋণের অতিরিক্ত সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে খামারিরা খুব একটা লাভের মুখ দেখছেন না।
ক্রেতা শামসুল আলম বলেন, শহরের মধ্যে বাসা। গরু রাখার জায়গা নেই। তবুও কোরবানির আগে গরু কিনে লোক রেখে প্রতিবছর লালন পালন করতাম। এবছর শুনতেছি বসন্ত রোগের আক্রমণ। আগে গরু কিনে রাখলে যদি রোগাক্রান্ত হয় তাহলে তো সেই পশু দিয়ে কুরবানি করা যাবে না। আবার কিনতে হবে। কিন্তু বাজেট তো আর ডাবল রাখা হয়নি।
আরেক ক্রেতা নুরুল হুদা জানান, দেশি গরুর চাহিদা বেশি, তাই অন্যান্য গরুর চেয়ে তুলনামূলক দেশি গরুর দামও বেশি। যদি ভারতীয় গরু আসে তাহলে দেশি গরুর উপর চাপ কমবে, দামও কমবে সেই আশায় অপেক্ষা করতেছি।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ ডা. মো. ছাহেব আলী বলেন, জেলায় প্রায় ১৯ হাজার পশু কেনাবেচা হবে বলে আমরা আশা করছি। জেলার ৪ উপজেলার প্রতিটি খামার পরির্দশন করে প্রয়োজনীয় পরামর্শসহ ওষুধপত্র দিচ্ছি। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে অবৈধভাবে ভারতীয় গরু দেশে প্রবেশ করে আমাদের খামারিদের লোকসানের মুখে না ফেলে।
প্রতিনিধি/এসএস

















































































































































































































































































































