পঞ্চগড়ের রুবিনা আক্তার (২৬)। স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষে সরকারি চাকরি করবেন। হাল ধরবেন দরিদ্র পরিবারের। কিন্তু তা আর হলো কই? ট্রেনে কাটা পড়ে দুটি পা-ই হারাতে হয়েছে তাকে। কালবৈশাখী ঝড়ের মতো নিমিষেই ইতি ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এই ছাত্রীর সব স্বপ্নের। এতকিছুর মাঝেও দমে যাননি রুবিনা। শুরু করেন নতুন স্বপ্ন দেখা। বেছে নেন গরু পালার কাজ। এতে সফলও হন তিনি।
রুবিনার বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দণ্ডপাল ইউনিয়নের বিনয়পুর জংলী পাড়া এলাকায়। তার বাবার নাম মৃত রবিউল ইসলাম। এবারের কুরবানির ইদে অদম্য রুবিনার খামারে রয়েছে এখন ১১ মণ ওজনের একটি ষাঁড়। যার নাম রেখেছেন ‘স্বপ্নরাজ’। কুরবানীর হাটে বিক্রির জন্য স্বপ্নরাজের দাম ধরেছেন ৯ লাখ টাকা।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: পোড়ামাটির বিস্কুট— ‘ছিকরের’ খোঁজে
জানা যায়,পা হারানো রুবিনার করুণ ঘটনাটি ২০১৮ সালের। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া রুবিনা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। পড়াশোনা করতেন মেসে থেকে। একটি ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তি ও প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ যোগাড় করতেন তিনি। একদিন ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার জন্য কমলাপুর রেল স্টেশনে যান রুবিনা। সেখানেই পড়েন দুর্ঘটনার কবলে। এক প্লাটফর্ম থেকে আরেক প্লাটফর্মে যাওয়ার সময় মাথা ঘুরে রেললাইনের ওপর পড়ে যান তিনি। এ সময় একটি রেল ইঞ্জিন ঘোরানো হচ্ছিল। ওই ইঞ্জিনের চাকার নিচে কাটা পড়ে রুবিনা আক্তারের দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রুবিনা এখন চলাফেরা করেন হুইল চেয়ারে। তবে দরিদ্র পরিবারেও বোঝা হননি তিনি। দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে পাওয়া চিকিৎসা সহায়তার এক লাখ টাকা দিয়ে শুরু করেন গরু লালর-পালনের কাজ। তিন বছরে তৈরি করেছেন ‘স্বপ্নরাজ’। স্বপ্নরাজের কাঙ্খিত দাম পেলে পরিবারে অনেকটাই স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে বলে প্রত্যাশা রুবিনার।
রুবিনার বাবা রবিউল ইসলাম ছিলেন দিনমজুর। ২০১৪ সালে মারা যান তিনি। সম্বল বলতে চাষের দেড় বিঘা জমি। তারা দুই বোন ও এক ভাই। বোনের মধ্যে তিনি ছোটো। বড় বোন জুলেখা খাতুন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, বাড়িতেই থাকেন। ছোট ভাই রুবেল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হুইল চেয়ারে বসেই স্বপ্নরাজের দেখভাল করছেন তিনি। ঘাস কেটে দিচ্ছেন, পানি খাওয়াচ্ছেন। একইভাবে অন্যান্য কাজও করেন রুবিনা। সব দিক থেকে তাকর সহযোগিতা করেন মা রহিমা বেগম।
কথা হয় রুবিনার সঙ্গে। জানান, দুই পা হারিয়ে বাড়ি এসে সিদ্ধান্ত নেন গরু পালনের। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া চিকিৎসা সহায়তার সেই টাকাটা দিয়ে একটি গাভী ও বাছুর কিনেন তিনি। তবে অভাবের কারণে গাভীটিকে বেশিদিন রাখতে পারেননি। গাভী বিক্রি করে যত্ন নেওয়া শুরু করেন বাছুরটির। মাতৃস্নেহে সেই বাছুরটিকে বড় তুলেন তিনি। এই ষাঁড়টিকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। তাই এর নাম দিয়েছেন ‘স্বপ্নরাজ।’
আরও পড়ুন: তিনি ‘কিং অব কুড়িগ্রাম!’
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, স্বপ্নরাজকে প্রাকৃতিক উপায়েই বড় করেছেন তিনি। প্রতিদিন ব্যবসায়ীরা আসছেন স্বপ্নরাজকে কিনতে। তবে দামে না হওয়ায় বিক্রি করছেননা। বর্তমানে স্বপ্নরাজের পেছনে দৈনিক ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা খরচ করতে হয় বলে জানান রুবিনা। এতে হিমশিমও খেতে হয় তাদের। তারপরও স্বপ্ন দেখেন কুরবানীর হাটে ভালো দামে বিক্রি করার। প্রত্যাশীত দাম পেলে স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে পরিবারে। তবে রুবিনার আক্ষেপের যেন শেষ নেই।
তিনি আরও বলেন, দুই পা হারিয়ে চার বছর ধরে ঘরবন্দি রয়েছি। কেউ খোঁজ নেয়নি। প্রতিবন্ধী ভাতাও মিলেনি এখনও। আবেদন করেও কাজ হয়নি। জানি না আল্লাহ আমার ভাগ্যে কী রেখেছেন।
রুবিনার মা রহিমা বেগম বলেন, স্বপ্নরাজকে নিয়েই আমাদের মা-মেয়ের সারাদিন কাটে। দুজনে সামলাতে পারি না। তারপরও করার কী আছে? শ্রমিক নিয়ে কাজ করাবো এমন সাধ্যও তো নেই। মেয়ের স্বপ্ন স্বপ্নরাজকে বিক্রি করে পরিবারের অস্বচ্ছলতা দূর করবে, ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাবে। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে আমরা বড় পরিসরে একটা গরুর খামার করতে চাই। এজন্য যদি কোন সহযোগিতা পেতাম তাহলে বড় উপকার হত।
আরও পড়ুন: ধামরাইয়ে ৪০০ বছরের পুরনো রথযাত্রা উৎসব
দণ্ডপাল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজগর আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, রুবিনা এতদিনেও প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে না এটা দুঃখজনক। আমি নতুন চেয়ারম্যান হয়েছি। সুযোগ সুবিধা এলে তাকে দেওয়া হবে। ওই পরিবারে আমার সুদৃষ্টি সবসময় থাকবে।
দেবীগঞ্জ উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সারাবন তহুরা ঢাকা মেইলকে বলেন, মাসখানেক আগে আমি রবিনাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার গরুটি দেখে এসেছি। আমরা তাকে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।
প্রতিনিধি/এএ

















































































































































































































































































































