গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নিয়ে নানা কারসাজির অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর লালবাগ এলাকার চামড়া ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চাইতে অনেক কমে গরুর চামড়া কিনছেন তারা। বাণিজ্যমন্ত্রীর চামড়া রফতানির হুঁশিয়ারিও তোয়াক্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন লবণের দামকে। বলছেন, লবণের দাম চড়া, এজন্য সরকার নির্ধারিত দরে চামড়া কেনার সুযোগ নেই তাদের।
বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) ঈদুল আজহার সন্ধ্যায় রাজধানীর লালবাগের পোস্তা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে চামড়া আড়তদারদের একচেটিয়া আধিপত্য। তারা যত দর দিচ্ছেন সেটাই চূড়ান্ত। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে অনেকটা অসহায়।
বিজ্ঞাপন
এদিন বিকেল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া বোঝাই ট্রাক এবং ভ্যানগাড়ি আসতে থাকে পোস্তা এলাকায়। চামড়া আসতে দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার বাইরে থেকেও।
সরেজমিনে দেখা যায়, চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিয়ে টাকাসহ দাঁড়িয়ে আছেন আড়তদাররা। প্রস্তত রয়েছে ট্রাক থেকে চামড়া নামানোর, চামড়ায় লবণ দেওয়ার কর্মী এবং হিসাবরক্ষক। আড়তের মধ্যে থরে থরে সাজানো রয়েছে লবণের বস্তা।

তবে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আসা মাত্রই আড়তদারের আচরণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাদের আচরণে মনে হয় চামড়া কিনতেই তারা আগ্রহী নন। অনেকটা করুণা করে কিনছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের শরণাপন্ন হলে দাম কষাকষির আগেই কর্মীদের লাগিয়ে দেন ট্রাক থেকে চামড়া আড়তের ভেতরে ঢোকানোর কাজে। সঙ্গে সঙ্গে চামড়ায় লবণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এরপর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় চামড়ার দাম। আর সে দাম নিয়ে আপত্তি থাকলেও কিছুই করার নেই মৌসুমি ব্যবসায়ীদের।
বিজ্ঞাপন
পোস্তা এলাকার অন্তত ২৫টি ট্যানারি ঘুরে দেখা গেছে, মাঝারি আকারের গরুর চামড়ার জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে চামড়া প্রতি গুজে দেওয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। চামড়ার আকার বড় হলে তার জন্য দেওয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা করে। আড়তদাররা বাড়তি মুনাফার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছেন বাতিল চামড়া। বাছাইয়ের সময় কিছু চামড়াকে বাতিল হিসেবে গণ্য করছেন আড়তদাররা। কেউ সেই চামড়ার নামমাত্র দাম ধরছেন, কেউবা একেবারেই দাম নিতে নারাজ।
পোস্তা এলাকায় গরুর চামড়া নিয়ে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ী খালিকুজ্জামান ঢাকা মেইলকে জানান, তিনি একশ চামড়া নিয়ে এসেছেন। তিনি পোস্তায় আসা মাত্রই এক পাইকার দামদর ঠিক না করেই চামড়া তার দোকানে ঢুকিয়ে ফেলেন। একশ চামড়া বাছাই করে ৩২টি বাতিল বলে জানান আড়তদাররা।
খালিকুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা করে নিজেই কিনে আনছি। আমাকে কথা বলারই সুযোগ দিল না। মাল ট্রাক থেকে নামাইয়া নিলো। ৭০০ করে দাম ধরছে। লাভ হয় নাই৷ কিছু টাকা লস হইছে, সারাদিন খাটছি ফাও। ৩২টা চামড়া বাতিল বলছে। সেগুলো ৩০০ টাকা করে ধরেছে।'

একই ঘটনা ঘটেছে শরিফুল ইসলামের সঙ্গে। ৬৭টি চামড়া এনে দাম পেয়েছেন ৬০০ করে। এরমধ্যে বাতিল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ১২টি। বাতিল চামড়ার দাম পাননি।
এদিকে ওই এলাকার যানজট ঠেকাতে পোস্তার প্রবেশ ও বহিঃগমন পথে দায়িত্বরত আছেন অনেক আড়ত কর্মী৷ প্রবেশদ্বারেই অনেকে চামড়ার দরদাম ঠিক করছেন, সেখানে দাম শুরু হয় ২০০ টাকা থেকে।
বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত পোস্তা এলাকায় সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে মাদরাসা থেকে আগত চামড়া। মাদরাসার জন্য চামড়ার দাম কত ধরা হলো- এমন প্রশ্নের উত্তর মেলেনি মাদরাসার প্রতিনিধি বা আড়তদারদের থেকে।
নারায়ণগঞ্জের ছনটেক মহিলা মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মাওলানা রশিদ আহমদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা ৩০০ চামড়া সংগ্রহ করেছি। এগুলো পরিচিত ব্যবসায়ীর কাছে দিয়ে দিচ্ছি। প্রয়োজন মতো উনার কাছ থেকে টাকা নেব। উনি আমাদের ঠকাবেন না।
চামড়া কেমন দামে কেনা হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মী পরিচয়ে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে আনাগ্রহ প্রকাশ করেন বেশ কয়েকজন আড়তদার। এমনকি নিজের নাম-পরিচয় জানাতেও আপত্তি করেছেন তারা।
তবে তারা দাবি করেন, এবার লবণের দাম বেশি। তাই বাধ্য হয়ে তারা কম দামে চামড়া কিনছেন।
একজন আড়তদার নাম প্রকাশ না করে বলেন, 'একটা চামড়ায় চার কেজির মতো লবণ লাগতেছে৷ এক কেজি লবণের দাম ৫০ টাকা। আবার অনেক চামড়া বৃষ্টিতে ভিজছে। নষ্ট হইতে পারে। যেমন চামড়া তেমন দাম।'

গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় লুকিয়ে চামড়ার দাম জানতে চাইলে কালাম ব্যাপারী নামের একজন আড়তদার বলেন, ‘গরুর চামড়া ৬০০ টাকা থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা দরে কিনছি। এখনো তেমন চামড়া আসে নাই। রাতের দিকে প্রচুর চামড়া আসবে।’
পোস্তায় চামড়ায় লবণ দেওয়ার পর এই চামড়া চলে যাবে সাভারের হেমায়েতপুরে। সেখানে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হবে।
পোস্তার চামড়ার শ্রমিক মো. রিজু ঢাকা মেইলকে জানান, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া এবার ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় কেনা হচ্ছে। চামড়ার আকার খুব বড় হলে সেক্ষেত্রে ৮০০ টাকা হারে কেনা হচ্ছে।
এদিকে চামড়া কেনা-বেচা হয়েছে হাজারীবাগেও৷ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকেই লাভবান হয়েছেন হাজারীবাগে চামড়া বিক্রি করে।
সেখানে ৭৬টি চামড়া নিয়ে এসে বিক্রি করা মো. হাবিব ঢাকা মেইলে জানান, ভালো চামড়া ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। বাতিলগুলো বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকা দরে৷
এদিকে হাজারীবাগের আড়তদাররা ছাগলের চামড়া কিনছেন না। তবে পোস্তায় ছাগলের চামড়া কেনা হচ্ছে নামমাত্র দামে। একেকটি ছাগলের চামড়ার জন্য দাম দেওয়া হচ্ছে মাত্র পাঁচ টাকা।
কারই/কেআর/জেবি

















































































































































































































































































































