ঈদ মানেই ছুটি, ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদের ছুটিতে পরিবার পরিজনের সঙ্গে উৎসব আনন্দে মেতে ওঠে। তবে ঈদে প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়ে সবাই আনন্দে মেতে উঠলেও এই উৎসবে ছুটি মেলে না হাজারও মানুষের।
পেশাগত দায়িত্ব পালনে তৎপর থাকতে হয় তাদের। দায়িত্বের বোঝা নিয়ে উৎসব আনন্দের ঊর্ধ্বে থেকে চলে তাদের ঈদ আনন্দ। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সবাই যখন ঈদের খুশি ভাগাভাগিতে ব্যস্ত তখন শেরপুরের বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি দফতরের কর্মীদের ঈদ আনন্দ চলে পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে দিয়ে। তাদেরই খোঁজ নিয়েছে ঢাকা মেইল।
বিজ্ঞাপন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: দায়িত্বের মাঝেই ঈদ আনন্দ খুঁজেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এদের কেউ কেউ ঈদের ছুটিতে গ্রামে যেতে পারলেও, অনেকেই ঈদের দিনও থাকবেন কর্মস্থলে। সাধারণ মানুষের ঈদের আনন্দকে নির্বিঘ্নে করতে তারা রাত-দিন পরিশ্রম করে দায়িত্ব পালন করবেন। নাড়ির টানে অনেকে বাসা কিংবা অফিসে তালা ঝুলিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন। তাদের সবকিছু নিরাপদে থাকার জন্য নগরজুড়ে নিরাপত্তা দিতে প্রহরায় থাকবেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। একই দায়িত্ব পালন করবেন বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিসের নিরাপত্তা কর্মীরাও।
বিশেষ করে ট্রাফিক বিভাগে যারা আছেন তারা ঈদের আগের ও পরের দিনগুলোতে থাকেন প্রচুর চাপে। কথা হয় শেরপুর ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট রুবেল মিয়ার সঙ্গে৷ তিনি বলেন, আমাদের সবার ছুটি ত সম্ভব না। যাদের ছুটি মেলে না, তারা কাজের মধ্যেই ঈদের আনন্দ উপভোগ করার চেষ্টা করি। যদিও পরিবার পরিজন ছেড়ে ঈদ করাটা খুব কষ্টের। শহরের খরমপুরের বেসরকারি একটি ব্যাংকের নৈশ প্রহরী আব্দুস সামাদ। কুড়িগ্রামে তার দেশের বাড়ি। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, বাড়িতে আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী সবাইকে ফেলে কর্মস্থলে ঈদ করাটা কতটা খারাপ লাগে, তা বলতে পারব না। তবুও জীবিকার তাগিদে ডিউটি তো করতেই হয়।
ডাক্তার-নার্স: হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোতে ঈদের দিনেও নির্বিঘ্নে সেবা দেয় চিকিৎসক নার্সরা। মানবতার সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের ঈদে খুব একটা ছুটি মেলে না। শেরপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে এমনিতেই চিকিৎসকের সংকট প্রকট। চাহিদার চেয়ে নার্স রয়েছে অর্ধেক৷ তাই ডাক্তার, নার্স, আয়া ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঈদ ছুটি তেমন একটা মিলে না।
বিজ্ঞাপন
কথা হয় হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের পেশার প্রধান লক্ষ্যই রোগীদের সেবা দেওয়া। আর শেরপুর হাসপাতালে এমনিতেই জনবল সংকট তাই খুব কম লোকেরই ছুটি হয়। আমরা রোগীদের সেবা দেওয়ার মাঝেই ঈদের আনন্দ খুঁজি। সেবা দেওয়ার মাঝেই আমাদের তৃপ্তি।
অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভার: খুব কম সময়ই পরিবারের সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভারদের ঈদ আনন্দ ভাগাভাগির সুযোগ হয়। কারণ ঈদের দিনও অনেক মুমূর্ষু রোগীদের শেরপুর হতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অথবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।
পৌর শহরের মোবারকপুর মহল্লার অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভার মিসকিন মিয়া। তিনি বলেন, আমরা ঈদের দিনও নিজেকে প্রস্তুত রাখি। রোগ ত আর বলে কইয়ে আসে না। রোগী পাওয়া মাত্রই ময়মনসিংহ বা ঢাকার উদ্দেশে আমরা চলে যায়। আর রাস্তা, গাড়ি ও রোগীদের সঙ্গেই আমাদের ঈদ কেটে যায়। এটাই আমাদের তৃপ্তি।
পরিছন্নতাকর্মী: যাদের কারণে শহর বাসাবাড়ি থাকে পরিস্কার তাদেরও ঈদে ছুটি খুব একটা মেলে না। শেরপুর পৌরসভার ময়লা পরিবহনের চালক জানান, কোরবানির ঈদে এমনিতেই চাপ বেশি কারণ কোরবানির বর্জ্য থাকে। সেগুলো দ্রুত পরিস্কার করতে হয়। তাই আমাদের অনেকের শিফট ভাগ করে ঈদের দিনও ডিউটি করতে হয়। এভাবেই কেটে যায় আমাদের ঈদ আনন্দ।
ফায়ার সার্ভিস: গতি সেবা ত্যাগ এ স্লোগানে ২৪ ঘণ্টায় নিজের প্রস্তুত রাখেন রাষ্ট্রের সেবায় ফায়ার সার্ভিস। ঈদে তাদেরও ছুটি খুব একটা মেলে না। কথা হয় শেরপুর স্টেশনের উপ পরিচালক জাবেদ আহম্মেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, গতি-সেবা-ত্যাগ এ তিনটি মন্ত্রে আমরা নিজেদেরকে সবসময় প্রস্তুত রাখি। কর্মস্থলেই ঈদের আনন্দ খুঁজি। যদিও পরিবার পরিজন নিজের গ্রাম ছেড়ে ঈদ অনেকটা বেদনার, কষ্টের তবুও রাষ্ট্রের সেবায় আমরা সবসময় প্রস্তুত থাকি। এখানেই আমাদের ঈদের তৃপ্তি
সাংবাদিক: যারা গণমাধ্যমে কাজ করে, তারা নিজেকে সবসময় প্রস্তুত রাখে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে নিউজ কভারেজ করার। এ ব্যাপারে কথা হয় শেরপুর ইয়ূথ রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের জেলা প্রতিনিধি ইমরান হাসান রাব্বির সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা যারা মফস্বলে কাজ করি, তাদের আসলে ওভাবে ছুটি নেওয়া হয় না। ঈদের দিনও নিজেকে প্রস্তুত রাখি, তথ্য পাওয়া মাত্রই যেন নিউজ কভারেজ করে অফিসে পাঠাতে পারি। এছাড়াও কোনো ঘটনায় লাইভ করতে হয় কখন, সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত রাখতেই হয়।
ইমাম মুয়াজ্জিন: মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিনেরা খুব কম সময়ই ঈদের ছুটি পান। বেশির ভাগক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের পরিবার পরিজন থাকেন অনেক দূরে। ঈদে অনেক গুরুদায়িত্ব তাদের ওপর। ঈদের নামাজ পড়ানো, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি। ঢাকা মেইলের কথা হয় শেরপুরের আখের মামুদ দারুল উলুম নূরানী হাফেজীয়া মাদরাসার মোহতামিম ও আখের মামুদ বাজার জামে মসজিদের ইমান হাফেজ ক্বারি মুহাম্মদ সোহাগ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, মসজিদের দায়িত্বে আছি। তাই বাড়িতে যায়নি। আমাদের মাদ্রাসার হুজুররা ছুটিতে গেছেন। তারা আসলে, দায়িত্ব দিয়ে পড়ে ছুটিতে যাব।
যাদের কারণে শহর থাকে সচল, সড়কে চলে বাস-ট্রাক, ঘুরে শিশু পার্কের রাইড, বাসায় বিদ্যুৎ, কলে পানি আর চুলায় গ্যাস, সচল থাকে টেলিফোন, শহর থাকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, রোগীরা পায় সেবা, তথ্য পায় দেশবাসী; ভালো থাকুক কর্মব্যস্ত সেই মানুষগুলোর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকা তাদের প্রিয় মুখগুলো।
প্রতিনিধি/এসএস