কোরবানি তো দিবার পারি না। হামি গরিব মানুষ। বাপের দেওয়া সাইকেলত বাকসত করে আইসক্রিম গ্রামত বেঁচে খাই। ছলপলের পড়ার খরচ, খাওয়ার খরচ, বাসা ভাড়া দিয়ে কোনো মতে জীবনডা ব্যাচে আখছি।
কোরবানি দেওয়ার টাকা তো দূরের কতা, এই এক বছর গোস্ত চোখত দেখিনি! ছলপোল তো আর বুঝে না, তারা সারাদিন দেখিচ্ছে বাড়ির ধারত গরু কিনে বেন্দে রাকিছে। কোরবানির দিন জবাই করবি! ছলেরা তো কিছু কয় না কিন্তু ফেল ফেল করে চাইয়া থাকে।
বিজ্ঞাপন
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ৬০ বছর বয়সী বসির মিয়া। বসির মিয়ার গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্নী বাড়ি ইউনিয়নে। ৩০ বছর ধরে থাকেন বগুড়া শহরের চান মারি ঘাট বস্তিতে। শহরের পাড়াগুলোতে কখনও আইসক্রিম, কখনও হাওয়ায় মিঠাই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
ঈদের দিনে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরবানির মাংস সংগ্রহ করেন বসির মিয়া আর বসিরের স্ত্রী ফুল বানু, আবার সেই মাংস এনে বিক্রি করেও দেন তারা।
বসির মিয়া বলেন, সবার বাড়িত গোশত খাওয়ার ধুম পড়বি আর হামরা জেকনা গোশত পামু সেক্না বিক্রি করে সংসার চালামু। গত বছর কোরবানি ঈদে তো তাই করছি, এবারও তাই করা লাগবি।
যে দিন পরিছে জিনিসের দাম যে হারে বাড়িছে। চাল কিনমু না তেল কিনমু না গোশত কিনমু কি করমু।
বিজ্ঞাপন
মানুষ হামাগরেক খাওয়ার জন্য গোশত দিবি দুই টুকরা তিন টুকরা। কেউ খালি তেল দিবি কেউ হাড্ডি দিবি। না খেয়ে সব এক সাত করে বিক্রি করমো।
এই গোশত কে কিনবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বসির মিয়া বলেন, বাজারত গোশতের দাম মেলা। হামরা কেন, হামাগরে চেয়ে যারা বেশি টাকা কামায় করে তারাও বছরে একবার গোশত কেনা পারে না। ওই ধরেন হামাগরে মতো কিংবা হামাগরে চেয়ে অবস্থা ভালো তারাই এগুলা গোশত কিনবি। আবার যারা কোরবানি দিবার পারেনি। তারা কিনে এগুলা গোশত। হামি কেন হামার মতো অনেকেই বেচে এই কোরবানিত পাওয়া গোশত।
তিনি বলেন, বাড়িত খাওয়ার জন্য এক-দেড় কেজি রাখমো, বাকিটা বিক্রি করে বাসা ভাড়া দিমু, ছলেগরে পড়ার টাকা দিমু। বস্তিত থাকি। তাও বস্তিমালিক সব মিলে ৪ হাজার টাকা নেয়। মাংস খাইলেই তো চলবে না, সব দিক চলা লাগবে।
বগুড়ার ফতেহআলি বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে কোরবানির ঈদের দিনে অনেক দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষ মাংস সংগ্রহ করেন। সেই মাংস আবার অর্থাভাবেও বিক্রি করেন।
এসব মাংসের ক্রেতাও আবার নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ, বছরের অন্যান্য সময়েও যাদের গরুর মাংস কেনার ক্ষমতা নেই তারাই। সাধারণত এসব মাংসের কেজি ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে বিক্রি করা হয়।
বগুড়া শহরের বিভিন্ন পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় মৌসুমি কসাইদের। তারা অনেকেই অনেক দূর থেকে এসে শহরে ঈদের দিন কসাইয়ের কাজ করেন।
মৌসুমি কসাই বাবু মিয়া বলেন, আমার বাড়ি গাইবান্দা চরে। আমি রিকশা চালায়। আর প্রতিবছর কোরবানি ঈদ আসলে আমি কসাইয়ের কাজ করি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। সেখান থেকে ভাগে প্রায় গরুর ওজন ভেদে ১০ থেকে ১৫ কেজির মতো গোশত পাই। আর সকাল আর দুপুরে একটু গোশত দিয়ে ভাত খাবার পাই। বাড়ির জন্য কিছুটা রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিই।
সহিদা বেগম নামে এক নারী বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গোশত সংগ্রহ করে পাওয়া গোস্ত নিয়ে বাজারে বেচি। কিছুটা বাড়ির জন্য রেখে বাকিগুলো বিক্রি করি।
হাফিজ নামে এক ক্রেতা বলেন, আমি রিকশা চালাই। তেমন আয় না থাকায় অল্প দামে মাংস কিনে নেই যারা বিক্রি করে তাদের কাছ থেকে। গত বছর ২ কেজি কিনেছিলাম। আল্লাহ চাইলে এবারও কিনব।
এই কোরবানির গোসত কেনা বেচা নিয়ে বগুড়া শহরের বিশিষ্ট সমাজসেবী ওহিদুল আলম বলেন, শহরের থানা মোড় এলাকা, ১ নম্বর ও ২ নম্বর রেল ঘুমটি, হাড্ডিপট্টি এবং রেল লাইনের ওপর ছোট ছোট ভাগা দিয়ে প্রতি বছরি বিক্রি হয় কোরবানির মাংস।
তবে পেশাদার কোনও মাংস ব্যবসায়ী এ গোসত বিক্রি করেন না। মৌসুমি কসাই, দিনমজুর, দুস্থ্, ভিখারি-গরিব, শিশু যারাই কিছু মাংস জোগাড় করতে পারেন, তা নিয়েই বসে যান বিক্রি করতে। মাংস বিক্রেতা হিসেবে কিছু শিশুকেও দেখা যায়।
শহরে মূলত বিকেল তিনটা থেকে এই বিক্রি জমতে শুরু করে। বেচাকেনা চলে সন্ধ্যা-রাত পর্যন্ত। এই হাটের ক্রেতারা মাংস কিনে কেউ ঠকেন, কেউ আবার জিতেন। কোরবানির ঈদে পরিবার-পরিজন নিয়ে মাংস খাবেন, এ ইচ্ছাতেই এসব হাট থেকে মাংস কেনেন অনেকে।
প্রতিনিধি/এসএস