বিস্কুট যদি হয় পোড়া মাটির তৈরি— সেটা আবার কেমন! শুনতে অবাক লাগলেও বিষয়টি সত্য। কোনো একটা সময় ক্ষুধা নিবারণের জন্য এটি তৈরি হতো। এখনও অনেক মানুষ সেই মাটির বিস্কুট খায়। সিলেট অঞ্চলে এই বিস্কুট ‘ছিকর’ নামে পরিচিত।
জানা যায়, একটা সময় ছিকর খাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ ও নানান যুক্তি ছিল। তার ভেতর ক্ষুধা নিবারণ যেমন ছিল, আবার ছিল প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানের প্রাপ্তি ও রক্তস্বল্পতা রোধের পুরোনো ধ্যান ধারণা। এর পাশাপাশি একটু বেশি জনপ্রিয়তার নজরে থাকতো সন্তানসম্ভবা নারীদের কাছে। প্রচলিত ধারণা ছিল, ছিকর রক্তশূন্যতা দূর করে, খনিজের যোগান দেয়। গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট প্রয়োজন হয় খনিজের। কিন্তু জিওল মাছ (শিং-মাগুর-কই) খেতে পারার সামর্থ্য সবার ছিল না। তাই সেই জায়গা করে নিয়েছিল ছিকর। এর ছিল আলাদা স্বাদ। অনেক ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারাও স্বাদের কারণে ভক্ত হয়ে যেত। সন্তানসম্ভবা নারীসহ অনেকেরই বেশ পছন্দের মাটির তৈরি বিস্কুট ছিকরের। তাদের বিশ্বাস ছিল, এটি খেলে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আবার অনেকের মতে, শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্যই নয় বরং এক ধরনের অভ্যাসের বশেই লোকজন ছিকর খেতেন। যদিও এসব ধারণার পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা সমর্থন মেলেনি।
আরও পড়ুন: নীলফামারীতে ব্রিটিশ রানির বিলাসবহুল সেলুন কোচ
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার ছাড়াও হবিগঞ্জের বানিয়াচং, বাহুবল ও মাধবপুরে ছিকরের মাটি পাওয়া যেত প্রচুর পরিমাণে। ছিকর হচ্ছে একধরণের পোড়া মাটি। পাহাড়ি টিলায় গর্ত খুড়ে তুলা হয় এক ধরণের মিহি মাটি। তারপর তা মাখিয়ে খাই বানিয়ে ছাঁচে ফেলে প্রথমে তৈরি করা হয় মন্ড। তারপর তা পছন্দ মতো কেটে বিভিন্ন আকারে টুকরো করা হয়। পরে বিশেষ এক পদ্ধতিতে সেই টুকরো পোড়ানো হয় আগুনে। এইভাবে তৈরি হয় ছিকর। বিভিন্ন এলাকার ছিকর ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের হয়ে থাকে বলে জানা গেছে।
মৌলভীবাজার শহরের বেশকয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, শহর সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় শব্দকর সম্পদায়ের মানুষজন বসবাস করতেন। একসময় সেখানকার নারীরা এসব ছিকর তৈরি করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করতেন। দিনে দিনে ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ায় ছিকর এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে ছিকরের কদর কমে যাওয়ায় তারাও পেশা পরিবর্তন করেছেন। এখন আর ছিকর বাড়িতে বাড়িতে ফেরি করে বিক্রি না হলেও নির্দিষ্ট স্থান বা হাতেগোনা ছোটখাটো দুএকটি দোকানে যৎসামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন: রফিকুলের গাছে ঝুলছে কিং অব চাকাপাত
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মৌলভীবাজার জেলা শহরের টিসি মার্কেট এলাকার ছোট এক দোকানে পাওয়া যায় এই ছিকর। কথা প্রসঙ্গে দোকান মালিক সবুজ মোদক জানান, মাঝেমধ্যে অল্প সংখ্যক ক্রেতারা ছিকর খুঁজতেন, তাই তিনি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ছিকর সংগ্রহ করে প্রায় তিন বছর ধরে এই পণ্য বিক্রি করছেন।
আগে যারা ছিকর তৈরি করতেন তারা এখন চাহিদা কমে যাওয়ায় এই পেশা পরিবর্তন করেছেন। তাই সবসময় ছিকর পাওয়া যায় না। অনেক সময় বেশি দাম দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। এখন প্রতি কেজি ২শত টাকায় বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুন: ৯৮ বছরেও স্বাদ কমেনি হোবা ঘোষের মিষ্টির!
ছিকরের ক্রেতারা কারা? —ঢাকা মেইলের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুরুষের তুলনায় মহিলা ক্রেতাদের সংখ্যা একটু বেশি। তবে ক্রেতা সাধারণ বেশির ভাগ সময়েই ১০০ থেকে ২৫০ গ্রাম পরিমাণের ছিকর কেনেন। কে, কী কারণে নেন জানি না। তবে এর স্বাদ একটু আলাদা, হয়তো তাই তারা কেনেন।’
বিজ্ঞাপন
ওই দোকানে ঢাকা মেইলের এ প্রতিবেদক ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়ানো পর দেখা মেলে একজন ক্রেতার। আলাপকালে ক্রেতা আব্দুল মিয়া জানান, মাঝেমধ্যে শখের বসে খেতেন, এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন এক-দুইটা খান। অন্য রকমের এক স্বাদ আছে বলে তিনি জানান।
কেমন লাগে খেতে? —এমন প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, ‘ভালই। উপকার অপকার জানি না, খেতে ভালো লাগে তাই খাই।’
প্রবীণদের সঙ্গে আলাপকালে আরও জানা যায়, সত্তরের দশকের দিকে ধান চালের বিনিময়ে এই ছিকর বিক্রয় হতো। তখন বাড়ির গিন্নিরা অনেক সময় স্বামীকে লুকিয়ে ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে এই ছিকর সংগ্রহ করতেন। পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামের বাজারে ছিকর পাওয়া যেত। তবে এখন আর সচরাচর তা দেখা যায় না।
আরও পড়ুন: রাজশাহীর ‘ব্রেকআপ টেবিলে’ যত কারবার | লিটনের হাত ধরে কুষ্টিয়ায় ‘ইউটিউব ভিলেজ’, আছে পার্কও
জানা যায়, বর্তমানে ছিকরের চাহিদা কমে যাওয়ার পেছনে যেমন আছে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা বা হতদরিদ্র মানুষদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি, তেমনি আছে সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারটিও। এখন সাধারণ মানুষজনের মাঝে এসেছে সচেতনতা। অনেকেই জানেন যে, এর ভেতর আসলে কী কী উপাদান আছে, আর কী নেই। নারীরাও এখন এক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছেন।
তবে আজও দেশের বেশ কিছু এলাকায় প্রচলিত আছে ছিকর। বর্তমানে অনেকেই শখের বশে এই মাটির বিস্কুট খেয়ে থাকেন। পাশাপাশি অনেক দেশি পণ্যের উদ্যোক্তারাও এখন অনলাইনে ছিকর বিক্রি করে থাকেন বলে জানা গেছে।
প্রতিনিধি/এএ