শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘পদ্মা সেতু’র এক বছর: দ্বার খুলল শত সম্ভাবনার

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৬ এএম

শেয়ার করুন:

‘পদ্মা সেতু’র এক বছর: দ্বার খুলল শত সম্ভাবনার

দেশ ও জাতির সক্ষমতার অনন্য প্রতীক হয়ে প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম বহুমুখী পদ্মা সেতু। এই সেতু আমাদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। সব ধরনের বাদানুবাদ এবং প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাসহ নানা বাধা-বিপত্তি জয় করে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই ‘পদ্মা সেতু’ এখন সারা বিশ্বের কাছে এক চ্যালেঞ্জিং নাম। দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের সেতু পদ্মা। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনে পদ্মা নদীই ছিল একমাত্র বাধা। পদ্মায় সেতু হওয়ায় সে বাধা কেটেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। আজ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণের এক বছর। তাই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নতুন সম্ভাবনার দ্বার এখন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য এই দিনে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করে যাতায়াতের জন্য খুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধনের পর ২৬ জুন থেকে সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে শুরু করেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। রাজধানী ঢাকায় আসতে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের যে অসহনীয় ভোগান্তি, তার অবসান ঘটে। দীর্ঘদিনের একঘেয়েমি নৌযাত্রা আর ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার চিত্র নিমিষেই বদলে যায়। ভোগ করছেন নানা সুবিধা। তার মধ্যে একটি হলো গ্রামের সঙ্গে শহুরে মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে। পদ্মা সেতুর ফলে রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বারবার শিকড়ে ফিরতে পারছে। নিজ গ্রামে যখন-তখন যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ‘মন ভালো’ করতেও অসংখ্য মানুষ মুহূর্তেই ছুটে যান নিজ গ্রামে।

উদ্বোধনের পর গত ১১ মাসে পদ্মা সেতু থেকে ৬৭৪ কোটি টাকার বেশি টোল আদায় করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সেতু দিয়ে ৪৭ লাখের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছে। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন পদ্মা সেতু থেকে প্রায় ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা টোল আদায় করা হচ্ছে। আর গড়ে প্রতিদিন সেতু দিয়ে যানবাহন পারাপার হচ্ছে ১৫ হাজার ২২৩টি।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: একটি বাস্তব ঘটনা

বিশ্বাস একটি অদ্ভুত শক্তি- এটা কোনো ম্যাজিক বা অলৌকিক বিষয় নয়। এই একটি কথা আপনার মনোবল বাড়াবে। বাস্তব স্বপ্ন ও চেষ্টা কখনোই ব্যর্থ হয় না। রাইট ভাতৃদ্বয় স্বপ্ন দেখতেন এমন এক যন্ত্র বানাবেন যাতে করে আকাশে ওড়া সম্ভব। তারা তৈরি করলেন প্লেন। সভ্যতার চেহারাই পরিবর্তন হয়ে গেল তাদের এই আবিষ্কারের ফলে। আজ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্নের বাস্তবায়নের ১ বছর পূর্ণ হলো। তারা আজ ইচ্ছে করলেই গ্রামে যেতে পারেন। আবার গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে আসতে পারেন। পদ্মা সেতু চালুর আগে ঈদ ছাড়া দুই-একবারের বেশি বাড়ি ফেরা হতো না দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের। নৌপথের ভোগান্তির কথা মাথায় এলেই আর ঢাকা ছাড়তে ইচ্ছে করতো না। তাই তাদের দুই-তিন মাসের আগে বাড়ি যাওয়া হতো না। বর্তমানে পদ্মা সেতু হওয়ার পর থেকে গ্রামের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। শুক্র-শনিবার ছুটির দিনকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবারই বাড়ি ফিরতে থাকেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার মানুষ। দুদিন বাড়ি থেকে রোববার ঢাকায় এসে সরাসরি অফিস করেন, এমন সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

সেলিম আহমেদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, পরিবারের সবাই গ্রামে থাকে। তাই ইচ্ছে হলেই বাড়ি চলে আসি। বৃহস্পতিবার অফিস করে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গ্রামে আসি। আবার রোববার গিয়ে অফিস করি। গত এক বছরে অসংখ্যবার গ্রামে যাওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুর বড় সুফল আমার কাছে এটাই।

খায়রুল আলম নামে এক ব্যক্তি বলেন, আগে মন টানলেও বাড়ি ফেরা হতো না। এখন সুযোগ পেলেই বাড়ি চলে আসি। গ্রামের সতেজ পরিবেশ খুবই ভালো লাগে। কখনো কখনো রাতেও বাড়ি চলে আসি। এখন আর বাড়ি ফিরতে চিন্তা-ভাবনা করতে হয় না। ঘন ঘন গ্রামে আসা হয়। গ্রামের সঙ্গে দূরত্ব কমেছে, সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


>> আরও পড়ুন: ভেজালমুক্ত কোরবানির পশু ও বিড়ম্বনাহীন হাটের উদ্যোগ

পদ্মা সেতু চালুর পর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী গ্রামের মানুষগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে হরহামেশাই ছুটে আসছেন বাড়িতে। গ্রাম থেকে যারা এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ছিলেন, সেই শহুরে মানুষের আসা-যাওয়া বেড়েছে গ্রামের বাড়িতে। বাড়ছে মেল-বন্ধনও। পাশাপাশি পরিবার-পরিজন রেখে কংক্রিটের নগরে একঘেয়েমি জীবন-যাপন যারা করছেন, তাদের মনে প্রশান্তি জাগিয়েছে পদ্মা সেতু। খুব ভোরে রাজধানী ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তৈরি সকালের নাস্তা করেন এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক।

বিশ্বের বৃহত্তম ‘মাল্টিপারপাস ব্রিজ’ এই সেতু। পৃথিবীর গভীরতম পাইলের এই সেতুর ২৬৬ পাইলে ১ লাখ ৪৬ হাজার মেট্রিক টন স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত গেছে এই সেতুর অবকাঠামো। পদ্মা সেতুর নানা বিশেষত্বের মধ্যে আরও একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এই সেতুতে ব্যবহৃত ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’-এর সক্ষমতা হচ্ছে ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। যে কারণে রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকার সক্ষমতা রয়েছে এই সেতুর। চল্লিশটি পিলারের নিচের পাইল ইস্পাতের এবং তীরের দুটি পিলার কংক্রিটের। পদ্মা সেতুর আলোর ব্যবস্থাতেও রয়েছে বিশেষত্ব। সাধারণ আলোর ব্যবস্থা ছাড়াও আর্কিটেকচারাল লাইটিংও আছে। বিশেষ বিশেষ কোনো দিবস উদযাপনের সময় এই লাইটিংয়ের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করা যাবে। একসময়ের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলে এখন নানা ধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলমান থাকার জন্য স্বাভাবিকভাবেই দেশের বড় শিল্পপতিদের নজর পড়েছে এই অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য। এ জন্য তারা বিভিন্ন স্থানে জমি কেনার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছেন বলে মনে হচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলের কোথাও কোথাও ইতিমধ্যে জমির দাম বেড়ে গেছে দশগুণেরও বেশি।

দীর্ঘদিনের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের একসময়ের অতি সাধারণ কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন অঞ্চলে ইতোমধ্যে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল-মোটেলসহ ছোট-বড় রেস্তোরাঁ। ফলে কুয়াকাটার আগের সাধারণ গ্রাম্য প্রাকৃতিক চেহারা এখন আর নেই। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সামগ্রিক দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ায় নতুনভাবে আধুনিক চেহারায় সেজে উঠেছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা।

>> আরও পড়ুন: মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য কি নতুন?

প্রমত্ত পদ্মার দুই পাড়ের মানুষদের আতঙ্ক ছিল নদী ভাঙন। বছরের পর বছর ধরে পদ্মার ভাঙনে সহায়-সম্পদ হারিয়ে গৃহহীন হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। পদ্মা সেতুকে এই ভাঙনের কবল থেকে রক্ষার জন্য সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে নদী শাসন প্রকল্পের আওতায় পদ্মাপারের প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় নদীর তলদেশ খননসহ কংক্রিট ব্লক ও জিও ব্যাগ ফেলা এবং নদীতীর বাঁধাই করা হয়েছে। ফলে নদীভাঙনের কারণে আতঙ্কিত মানুষদের স্বস্তি মিলেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে এভাবে অন্যদের সঙ্গে পদ্মাপারের মানুষরাও নানাভাবে উপকৃত হয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে সরে দাঁড়ানোর পর বাংলাদেশ সরকারের আশা নিরাশায় পরিণত হয়। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ নিরাস হয়ে যান। তাদের মুখের হাসি হয় মলিন। তারা ভাবে, আর মনে হয় পদ্মা সেতু হবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষকে নিরাশ করেনি। প্রধানমন্ত্রীও নিরাশ হননি। তিনি মনের মধ্যে স্বপ্ন জিয়ে রেখেছেন। তিনি যখন বললেন, বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়নি তাতে কি হয়েছে। পদ্মা সেতু হবে, নিজেদের অর্থায়নেই হবে। সরকারের এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এমনকি বিশ্বব্যাংকও সমালোচনা করে। আড়ালে থেকে খিল খিল করে হাসে।

২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। দীর্ঘ ৮ বছর পর সর্বমোট ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে মূল সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং সংযোগ সেতুর ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটারসহ মোট ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার দেখিয়ে দিল- আমরাও পারি স্বপ্ন দেখতে, আমরাও পারি স্বপ্ন পূরণ করতে। এখন ঠিকই আওয়ামী লীগ সরকারের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মুখে হাসি ফুটেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। কলুপ এঁটে দিয়েছেন নিন্দুকের মুখে। দেশনেত্রী শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিলেন বিশ্ববাসীকে। পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

/জেএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর