অপেক্ষার প্রহর গুণছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ। মাত্র চার সপ্তাহ পরেই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে স্বপ্নের সেতুটি। সেতুটি চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে থেকে শুরু করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
প্রমত্তা পদ্মার বুকে নির্মিত স্বপ্নের সেতুটি নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। অনেকেই ভারতে নির্মিত এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ ভূপেন হাজারিকা সেতুর সঙ্গে তুলনা করছেন বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতুটিকে। পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ায় এবং সমসাময়িক সময়ে নির্মিত হওয়ার কারণে এই তুলনা করাই স্বাভাবিক।
বিজ্ঞাপন
পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যে লোহিত নদীর ওপর নির্মিত ভূপেন হাজারিকা লম্বায় এগিয়ে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে পদ্মা সেতু। কী কী কারণে পদ্মা সেতু এগিয়ে আছে জেনে নিন।
ভূপেন হাজারিকা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯.১৫ কিলোমিটার। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। সেজন্য অনেকেরই মনে প্রশ্ন, দৈর্ঘ্যে ছোট হলেও পদ্মা সেতুর ব্যয় বেশি কেন?
চলার পথ মসৃণ হলে তা চলা সোজা। কিন্তু তা যদি হয় বন্ধুর? পদ্মা নদী বাঙালির চেনা বহুকাল থেকে। তার ধ্বংসাত্মক আর প্রলয়ঙ্করী রূপ দেশবাসী দেখেছে অগণিতবার। উত্তাল স্রোত, গভীর তলদেশ, শক্তিশালী ঢেউ যার বৈশিষ্ট্য।
বিজ্ঞাপন
শিল্পী আব্দুল লতিফের গাওয়া ‘পদ্মারে তোর তুফান দেইখা/পরান কাঁপে ডরে; ফেইলা আমায় মারিস না তোর/সর্বনাশা ঝড়ে’ লাইনগুলোই যথেষ্ট পদ্মার ভয়ংকর রূপ বর্ণনার জন্য। সেই পদ্মার বুকে একটি সেতু তৈরির পরিকল্পনাই সাহসের বটে।
ভূপেন হাজারিকা সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতুর অনেক পার্থক্য রয়েছে। এসব পার্থক্য জানলে পরিষ্কার হওয়া যায় কেন এই সেতুটি তৈরিতে বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে।
পাইল লোড বিল্ডিং বা স্থাপনার এক ধরনের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি হচ্ছে পাইলিং। এটি স্থাপনার নিচে মাটির গভীরে লোড স্থানান্তর করে স্থাপনাকে দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করে। পদ্মা সেতুর পাইল লোড ৮ হাজার ২০০ টন। আর ভূপেন হাজারিকা সেতুর পাইল লোড মাত্র ৬০ টন। মাটির সর্বোচ্চ ভারবহন ক্ষমতা নিশ্চিতেই পদ্মা সেতুতে এত বেশি পাইল লোড দেওয়া।
খরস্রোতা নদীতে নির্মিত ব্রহ্মপুত্রের উপনদী লোহিত নদীর ওপরে তৈরি ভূপেন হাজারিকা সেতু। আর পদ্মা সেতু তৈরি করা হয়েছে খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর। বিশ্বের আর কোনো সেতু তৈরিতে নদীর এত তলদেশে গিয়ে পাইল গাঁথতে হয়নি। এত বড় পিলার বসানো হয়নি। তাছাড়া পদ্মার মতো শক্তিশালী ঢেউ বিশিষ্ট নদীর ওপর বিশ্বে সেতু হয়েছে কেবল একটি। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই বিশ্বের অন্যতম ব্যতিক্রমী সেতু হবে এটি।
ভূপেন হাজারিকা সেতু দুই লেন বিশিষ্ট। পৃথিবীতে এমন আরও কয়েকশ সেতুর খোঁজ মিলবে। কিন্তু পদ্মা সেতু তৈরি করা হয়েছে দ্বিতল নকশায়। এর নিচের পথে রাখা হয়েছে ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা। আর ওপরে অন্যান্য যানবাহন চলাচলের রাস্তা। এমন দ্বিতল সেতুর সংখ্যা বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি।
পদ্মা নদীর মাওয়া পয়েন্টে মাত্র ২০ সেকেন্ডে যে পানি প্রবাহিত হয় তা রাজধানী ঢাকার একদিনের প্রয়োজনীয় পানির সমান। হিসাব অনুযায়ী, প্রতি সেকেন্ডে পদ্মায় ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। এদিক বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরেই প্রমত্তা পদ্মার স্থান। আর তার ওপরই বুক চেতিয়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের গভীরতম পাইল বসানো হয়েছে পদ্মা সেতুতে। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত গেছে এই সেতুর অবকাঠামো। পদ্মা নদীতে পাথরের স্তর মিলেছে ১০ কিলোমিটার গভীরে। বিশ্বের অন্যান্য নদী যার ওপর সেতু রয়েছে, সেগুলোর কোনোটির পাথরের স্তরই এত নিচে নয়। পদ্মা সেতুর পাইল নদীর তলদেশে নিতে যে হ্যামার ব্যবহার করা হয়েছে তা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোলিক হ্যামার। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এমন শক্তিশালী হ্যামার ব্যবহৃত হয়নি।
পাথরের ব্যবহার পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত পাথরের প্রতিটির ওজন এক টন। পাকুর পাথর নামে পরিচিত এই পাথর ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য থেকে আমদানি করা হয়েছে। এমন আরও অনেক তুলনামূলক পার্থক্য রয়েছে যা থেকে সহজেই বোঝা যায় পদ্মা সেতু নিজ বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ। প্রমত্তা পদ্মার বুকে নির্মিত এই সেতু বিশ্ব দরবারে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
এনএম/এমআর