শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

ইকোপার্কে স্বপ্ন বুনছেন হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা

তানভীর আহমেদ
প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০২২, ০৮:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

ইকোপার্কে স্বপ্ন বুনছেন হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা
ছবি: ঢাকা মেইল

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের যাতায়াতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে যাচ্ছে প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। একদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে শিল্প-বাণিজ্য ও পর্যটনের প্রসারের সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। অন্যদিকে শিমুলিয়া-মাঝির হাট ঘাটকেন্দ্রিক হোটেল ব্যবসায়ী ও কয়েক হাজার কর্মজীবী মানুষ শঙ্কার আর অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। সবার দুশ্চিন্তা- ঘাট বন্ধ হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। এ জন্য সরকারের ঘোষণা মতো দ্রুত পদ্মার পারে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।

এ ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর তীরবর্তী মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়ায় ‘ইকোপার্ক’ নির্মাণে প্রকল্প হাতে নিয়েছে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় রিভারক্রুজ (নদী ভ্রমণ), চরে অবকাশ যাপন কেন্দ্র, প্রাকৃতিক ওয়াকওয়ে ট্রেইল, নৌ-জাদুঘরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হবে। সবমিলিয়ে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে সেখানে বছরে ৬০ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকের সমাগম হবে- এমন প্রত্যাশা থেকে এই বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর পর শিমুলিয়ায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অব্যবহৃত ১৫-১৮ একর জমিতে এসব স্থাপনা তৈরি হবে। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে এটি নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

Padma Bridge

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শিমুলিয়ায় ইকোবন্দর নির্মাণ করা হবে। এ ধরনের বন্দর বাংলাদেশে এটিই প্রথম। ফলে সেতু চালুর পর শিমুলিয়া ঘাটের ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট সার্ভিসে চাপ কমবে।

এদিকে, সরেজমিনে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাট ঘুরে জানা গেছে, স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর এই ঘাট হয়ে উঠবে সুনসান। কারণ, সেতু চালুর সঙ্গে সঙ্গে ফেরি ও লঞ্চঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ঘাটকে ঘিরে যাদের সংসারের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে তাদের মধ্যে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।


বিজ্ঞাপন


এ বিষয়ে শিমুলিয়া ঘাটের ভাই ভাই মোল্লা হোটেলের ম্যানেজার আনোয়ার বিশ্বাস বলেন, দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বিরাট অর্জন।

আনোয়ার বিশ্বাস বলেন, এই আনন্দের মাঝেও কিছু কষ্ট রয়েছে। কষ্টটা হলো পদ্মার দুই পারে লঞ্চ ও ফেরি ঘাটকেন্দ্রিক অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেতু চালু হলে ঘাটে যাত্রী কমে যাবে। আর যাত্রী কমে গেলে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে যাবে। তখন বাধ্য হয়ে মালিক বন্ধ করে দেবে। এরই মধ্যে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে হোটেল-রেস্টুরেন্টে কর্মরত কয়েক হাজার কর্মচারী বেকার হয়ে যাবে। তবে এরমধ্যে আশার কথা হলো- সরকার যদি এই ঘাটগুলো পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে তাহলে পর্যটকরা আসবে। পর্যটকরা এলে এসব হোটেল-রেস্টুরেন্টের ব্যবসা সচল থাকবে।

Padma Bridge

মাইশা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক কামাল হোসেন বলেন, মাওয়া ফেরিঘাট হওয়ার পর থেকে হোটেল ব্যবসা করছি। গত আট বছর হলো শিমুলিয়া ঘাটে এসেছি। পদ্মা সেতু চালু হলে ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে স্বাভাবিক নিয়মে। তখন আমাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা জানি না।

একই কথা জানিয়েছেন রূপসী বাংলা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার সোহেল আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা পুরো অনিশ্চয়তায় আছি। সেতু চালু হওয়ার পর যদি ঘাট বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। আর ঘাট চালু থাকলেও যাত্রীরা আর এখানে আসবে না। তবে একটা সম্ভাবনা রয়েছে। সেটা হলো- সরকার যদি এই ঘাটকে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরিত করে, তাহলে আমরা হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা বেঁচে যাবো।

তবে সেটা দ্রুত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেরি হলে আমরা পুঁজি হারিয়ে পথে বসে যাবো। ইতোমধ্যে আমরা অনেক লোকসান দিয়েছি। নতুন কোনো বিনিয়োগ করে আর ধরা খেতে চাই না। সরকারকে এখনই স্পষ্ট করে ঘাটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে হবে। নইলে কর্মসংস্থান হারিয়ে হাজার হাজার লোক বেকার হবে।

Padma Bridge

উল্লেখ্য, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি, মাঝির ঘাট নৌ-রুটে ৮৭টি লঞ্চ, দেড় শতাধিক স্পিড বোট ছাড়াও ১০টি ফেরি বর্তমানে সচল রয়েছে। এসব নৌযানে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী নিয়মিত পদ্মা পারাপার হন। এই যাত্রীদের ওপর নির্ভর করেই দুই পারের ঘাটগুলোতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঘাটের দুই পারে ৭০টির মতো খাবার হোটেল, স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ মিলিয়ে দুই শতাধিক ফলের দোকান, ১০০ চায়ের দোকান, ৫০টি কনফেকশনারি রয়েছে। এছাড়া পান, সিগারেট, ঝালমুড়ি, বাদাম, ছোলা, আচার, সেদ্ধ ডিম, সিঙ্গারা, নারকেল-চিড়া, শসা, দইসহ নানা রকম মুখরোচক খাবারের স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাও রয়েছে দুই হাজারের মতো। ঘাট না থাকলে এসব দোকান ও বিক্রেতাও আর থাকবে না। ফলে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিমুলিয়া নদীবন্দর ২০২০-২১ অর্থবছরে এক কোটি ৪০ লাখ যাত্রী ও ৩০ লাখ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহণ হয়েছে। ওই বছরে এই ঘাট ইজারা থেকে বিআইডব্লিউটিএর আয় হয়েছে সাত কোটি ৯০ লাখ ১২ হাজার ৩৭৬ টাকা। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় হয়েছে সাত কোটি ৬৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

Padma Bridge

পদ্মা সেতু চালুর পর সেখানে গাড়ি ও যাত্রী পারাপার কমে যাবে। এমন বাস্তব পরিস্থিতিতে নতুন আয়ের উৎস বের করতে শিমুলিয়ায় ইকোবন্দর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যদিও পদ্মা সেতু চালুর পরও শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি রুটে সীমিত আকারে ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোট সার্ভিস চালু রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর শিমুলিয়া এলাকায় বিআইডব্লিউটিএর কার্যক্রম অনেক সীমিত হয়ে পড়বে বলে ধারণা করছি। পদ্মা সেতু ও নদী দেখতে বিপুলসংখ্যক পর্যটক সেখানে যাবেন। পর্যটকদের জন্য আধুনিক বন্দর সুবিধা নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সেখানে আধুনিক নৌ-বন্দর, নদী ভ্রমণে আধুনিক নৌযান, পর্যটকদের নৌ-নিরাপত্তা সামগ্রী ও নদীর তীরভূমিতে বসার ব্যবস্থা করা হবে।

এছাড়া নৌ ঐতিহ্য সংবলিত জাদুঘরও নির্মাণ করা হবে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হবে।

টিএ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর