১৯৯৫ সালের গোড়ার কথা। বহু পুরোনো বাঁশ বাগানের তিন পাশ ঘিরে ছোট্ট একটি গ্রাম। পূর্বপাশে বিরাট বিল। ইতিহাসখ্যাত বিল বলধালি। গ্রাম্য রাস্তার ধারে বড় বড় আম-জাম, কাঁঠাল, শিরিষ, বাবলা গাছের মিতালি। পুরোটাই মাটির রাস্তা। সন্ধ্যার পর কেরোসিন বাতির আলো। অন্ধকার রাতে বাঁশাগান হয়ে ওঠে ভয়ংকর। শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকে সমস্ত গ্রামে এক ভয়াল পরিবেশ বিরাজ করে। জোনাকির আলো মিট মিট করে জ্বলে সারারাত। রাশেদদের বাড়িটা তিন রাস্তার কোনায়। রাস্তাটার এই জায়গা তেমাথা নামে সুপরিচিত। তেমাথা থেকে বিলের দিকে বেরোলেই মেঠোপথ। পথটি বহুশত বছরের পুরাতন। এই রাস্তা বেয়ে বিলের ভেতর কয়েক কিলোমিটার হাঁটা যায়। বিলবলধালিতে মাছ ধরেই জীবন ও জীবিকা চালান রাশেদের বাবা জালাল শেখ।
আজ ২৯ রমজান। চাঁদ উঠলেই কাল ঈদ। রাশেদের বন্ধু একবারেই কম নয়। পনের বিশজন অন্তত হবে। বয়স তাদের দশ-বারো। গ্রামের পূর্ব ও উত্তর পাড়ার সবাই ঈদের চাঁদ দেখতে বিলবলধালিতে হাজির। শত শত ছেলে, যুবক, তরুণ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আগমন। আছরের নামাজের পর থেকেই বিল বলধালির রাস্তা জনাকীর্ণ আজ। সবার চোখ পশ্চিম আকাশে। সূর্য ডোবার আগে থেকেই চাঁদ খুঁজছে হাজার মানুষের অক্লান্ত অপলক চোখ। রাশেদ বন্ধু বান্ধবসহ রাস্তায় নামল। কারও হাত ধরে টান, কারও লুঙ্গি ধরে, আবার কারও উরুতে চিমটি দিয়ে দিয়ে হালকা দৌঁড়াচ্ছে আর বলছে, ও দাদা, ও কাকা, ও খুড়ো মেলা বড়ো চাঁদ উঠেছে। দেকতে পাওনি। আমি দেকিচি।
বিজ্ঞাপন
রাশেদের দেখাদেখি অন্য বন্ধুরা একই কাজ করলে, মুহূর্তেই সব শান্তি ও একাগ্রতা নিঃশেষ হয়ে এক লণ্ডভণ্ড অবস্থা সৃষ্টি হলো জনতার মাঝে। মুরুব্বিরা বার বার অনুরোধ, রাগ ও ধমক দিলেও কোনো কাজ হলো না। চাঁদ দেখা বাদ দিয়ে চাঁদ দেখার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল ওরা। হঠাৎ রাশেদের আপন চাচা ক্রোধে বিষ্ফোরিত হয়ে এসে, রাশেদের কান ধরে মারাত্মক টান দিয়ে বলল, তোরে আসতে কইছে কেডা? বাড়ি যা। না হলি পিটায়ে চামড়া তুলে নিবানে। বুজলি?
কানের ব্যথায় রাশেদ চিৎকার দিয়ে বলল, কান ছাড়ে দাও, চাচা। আমি বাড়ি চলে যাতিছি। আর কোনদিন চাঁদ দেকতি আসপো না। আমি কাল ঈদিউ যাব না।
জাকাত রাশেদের কান ছেড়ে দিল। রাশেদ আর কোনো কথাই বলল না। বন্ধুদের নিয়ে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসল। সূর্য ডোবার আগে কয়েকবার রাশেদের বন্ধুরা চিৎকার করে বললো, ঐ যে চাঁদ উঠেছে! ঐ যে চাঁদ উঠেছে!
চাঁদ দেখতে অপেক্ষারতরা বহুভাবে অতিসুন্দর করে আড়াআড়ি, সোজা, ডানে বামে নানাভাবে সরে চেষ্টা করেও যখন পেল না, তখন বৃদ্ধ তসের আলী জাকাতকে বলল, তোমার ভাইপো মানুষ হবে না। আমরা এতোগুলোন মানুষ। ওর কোন আক্কেল নেই। ধোঁকা দিয়েই যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
জাকাত বলল, চাচা রোজা থাইয়ে আপনার মতো পরহেজগার মানুষ যদি এই কোতা কয়, তালি তো মানুষ অবে না। তুমি আর অভিশাপ দিও না। আমি বাড়ি যাইয়ে ওরে গরুর দড়ি দিয়ে বাইন্দে পাচুনি দিয়ে পিটাবানে।
তসের সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, আফসোস! এরা মানুষ হচ্ছে না। এই প্রজন্ম দিয়ে কি হবে?
এরই মাঝে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সূর্য লাল ডগমগ করছে। দেখতে দেখতে ডুবে গেল সূর্য। সূর্য ডোবার সাথে সাথে রাশেদ চেঁচিয়ে উঠে বললো, ঐ যে চাঁদ!!
বন্ধুদের ডেকে বলল, দেখ!! ঐ যে! ঐ যে! চাঁদ!!
তারা বলল, কই কিচ্ছু দেকি না। তুই মিত্যে কচ্চিস। আমরা কিচ্চু দেকতি পাই না।
জাকাতের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। মনে মনে ভাবল, রাশেদকে সে এবার এমন উচিত শিক্ষা দেবে যে, আর যেন কোনদিন সে এমন কাজ না করে। দ্রুতগতিতে রাশেদের দিকে হাঁটছে। ক্রোধে চোখ জ্বলছে! এই অবস্থা দেখে কিছু মহিলা বলল, ও ছোট মানুষ। ওরে কিছু কইয়ো না।
জাকাতের কোনদিকে খেয়াল নেই। সে রাশেদের দিকেই হাঁটছে। রাশেদের নিকটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই রাশেদের বন্ধু ফজু বলল, এ শোন্ শোন্ আমিও চাঁদ দেকিছি। ঐ যে! ঐ দেখ! চাঁদ!!
এবার একে একে জুলু, দুলু, বিলু, মিলু সবাই একই কথা বলল। জাকাত ভাবল, সবগুলো বেয়াদব! ফুটবলের মতো লাথি মারবানে একসাথে সবগুলোরে। জাকাত এসেই রাশেদের কান ধরল। চপেটাঘাত করতে যাওয়ার মুহূর্তেই জুলু, দুলু, বিলু, মিলু সবাই একই স্বরে বলল কাকা, তুমি আগে দেকো। চাঁদ দেকতি না পাইলে ওরে মারো।
তাদের সমস্বরের ডাকে জাকাতের ক্রোধের কিছুটা অবসান হলো। কিন্তু রাশেদের কান ধরেই পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে বলল, কই চাঁদ? ক? চাঁদ কই? ক।
রাশেদ হাত দিয়ে ইশারা করল। জাকাতও সেদিকে নজর দিয়েই রাশেদের কান ছেড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, চাঁদ দেকা গেছে। চাঁদ দেকা গেছে।
এই কথা শোনামাত্রই জমায়েতের সকলে দৌঁড়ে রাশেদের দিকে এলো। বাচ্চারা পেছনে রয়ে গেল। সবাই চাঁদ দেখলেন। কাল ঈদ। এই আনন্দ নিয়ে যার যার বাড়ি চলে গেলেন।
আজ রাত রাশেদের সম্মানের রাত। জীবনে এই একটি রাতই প্রবল সম্মানের। অনেক অপমান কানমলা ইত্যাদি পেরিয়ে এই সম্মান। রাশেদও ভাবটা এমন নিচ্ছে যে, আকাশে চাঁদ সেই উঠিয়েছে। অন্যান্য ভাইবোনদের মাঝে তাই তার এমনি হাবভাব।
এভাবে কেটে গেলো রাত।
আজ ঈদ!! সর্বত্রই আনন্দ উচ্ছ্বাস! সত্যিকারের মিলনমেলা। নতুন কাপড় পরার উত্তেজনায় রাশেদ সময় পার করছে। সারা বাড়িতে সেমাই আর পিঠার গন্ধ। সকালবেলা গোসল সেরে আতর মেখেছে রাশেদ। বাবার সঙ্গে নতুন পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজে যাওয়ার সময় রাশেদ দেখছে, রাস্তায় মানুষেরা যেন এক আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে।
সেই সময় ছিলে এক সামাজিক ঈদ। নামাজের পর ফিরে এসে দুপুরে শুরু খাওয়ার ধুম। বন্ধু বান্ধব আত্মীয়-স্বজনের আসা যাওয়া চলতই। ঈদের মেলায় ছিল নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, হাতে ঘুরানো পুতুল, আর রঙিন বেলুন। পাড়ার ছেলে মেয়েরা দলবেঁধে সারা বিকেল নদী বিলের ধারে ঘুরে বেড়াত।
সময় বদলাতে থাকে। গৌরীপুর এখন আর ছোট্ট গ্রাম নেই। এটি এখন যেন আধুনিক গ্রাম্যনগরী। পুরোনো কাঁচা রাস্তাগুলো এখন পাকা হয়েছে, মোবাইল টাওয়ার দাঁড়িয়ে গেছে, আর ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে ইন্টারনেট। রাশেদ এখন ঢাকায় থাকে। বড় কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে। বিলু বিদেশে সেটেল হয়ে গেছে। তাদের জীবন এখন ব্যস্ত, প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। ঈদের প্রস্তুতিও বদলে গেছে। এখন সেই গ্রামেও তেমন কেউ ঈদের চাঁদ দেখে না। টিভির সামনে বসে খবর দেখে। বিলবলধালির সেই উৎসবমুখর জমজমাট পরিবেশ নেই। সামাজিকতা শেষ। এখন মানুষ, নতুন জামা বাজার থেকে কেনে না, অনলাইন শপিংয়েই সব হয়ে যায়। আতর মেখে মসজিদে যাওয়ার বদলে ঈদের নামাজ টিভিতে দেখে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না করে মোবাইলে ‘ঈদ মোবারক’পাঠায়, সাথে সাথে কিছু কিছু ডিজিটাল ঈদ কার্ড।
ঈদের আনন্দের ছবি তুলে ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামে পোস্ট দেয়, লাইকের অপেক্ষায় থাকে দিনরাত। বাড়ির অতিথিরা আসেন না, সবাই অনলাইনে ভিডিও কলে কথা বলেই ঈদ পর্ব শেষ করে।
ঈদের আগের রাতেও এখন কোনো উত্তেজনা নেই। মায়েরা একা ঘরে বসে পুরোনো দিনের কথা ভাবেন। যখন বাড়ি ভরা থাকতো আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর হৈ-হুল্লোড়ে। এখন সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। সবকিছু ম্লান। আনন্দ যেন বিরাণ ভূমির মতো। ঈদের দিন সকালেও কেউ ভোরে ওঠে না।
বিকেলে রাশেদ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ফেসবুকে ঈদের ছবি পোস্ট করে। বিলু বিদেশ থেকে ভিডিও কলে কথা বলে, কিন্তু সেটাও কৃত্রিম লাগে। আহারে জীবন! আন্তরিকতা শেষ। সর্বত্রই যান্ত্রিকতা। তাই সুখ নেই। আছে যন্ত্রণা।
আজ ফজরের নামাজের পর রাশেদের মায়ের মুখে দুঃখের ছায়া পড়ে আছে। পাশে বসে আছে রাশেদ। তিনি বললেন, আগের ঈদগুলোর কথা খুব মনে পড়ে, রাশেদ। তখন সবাই মিলে একসঙ্গে থাকতাম, এখন তো সবাই আলাদা হয়ে গেছি। ঈদের আনন্দ কোথায় যেন হারিয়ে গেল? আর কি কোনদিন সেই ঈদ ফিরে আসবে না! এই ঈদ যে আর একেবারেই ভালো লাগে না, রাশেদ!
রাশেদও তার মায়ের ভানার সাথে অতীতে হারিয়ে গেল। দু’চোখ বেয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসে অশ্রু। সেভাবে সত্যিই তো, ছোটবেলার সেই আনন্দ আর নেই। তখন প্রযুক্তি ছিল না, কিন্তু মানুষ ছিল একে অপরের কাছাকাছি। এখন সব ডিজিটাল হয়ে গেছে, কিন্তু মানুষের মন একা হয়ে গেছে। মানুষ এখন বড়ই একা।
রাশেদ তার মাকে বলল, পরের ঈদটা হবে পুরোনো দিনের মতো। আমি তা করবই ইনশাল্লাহ।
রাশেদের এই কথায় তার মায়ের মন হালকা হলো। তিনি বললেন বাবা, চেষ্টা কর। আমি তোমার সাথে আছি। দিন বদলাতেই হবে। এভাবে আর পারা যায় না। এ কেমন ঈদ! এতো আমাদের ধর্মের সাথে যাচ্ছে না। মানুষের খোঁজ সরাসরি নিতেই হবে।
রাশেদ সানন্দে বলে উঠল মা, নিজের চোখেই ঈদের চাঁদ দেখব। আমাদের শৈশবের মতোই ঈদ করব। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোলাকুলি করব, ছোটদের সালামি দেব, সবাই মিলে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেব। এভাবে ঈদের মতো এদেশের সবকিছুর পরিবর্তন আনতে হবে।
রাশেদের মায়ের চোখে জল। এক সাগর সুখের জল। এক আকাশ আনন্দের। রাশেদ ঘরের দরজা খুলল। দেখল, লাল টুকটুকে নতুন সূর্য উঠছে।