মঙ্গলবার, ১ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

মৃত্যুর আগে কত না কষ্ট পেয়েছে মেয়েটি...

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১৩ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩২ পিএম

শেয়ার করুন:

মৃত্যুর আগে কত না কষ্ট পেয়েছে মেয়েটি...

শখ করে বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো ছোট্ট শিশুটি। নানা শঙ্কার মধ্যেও বোনকে কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বড় বোন। কিন্তু কে জানত এই বেড়াতে যাওয়াই কাল হবে নিষ্পাপ এই মেয়েটির জন্য। বোনের লম্পট শ্বশুরের লোলুপ দৃষ্টি আর দুলাভাইয়ের সহযোগিতায় পাশবিক নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত হয় মেয়েটির পুরো শরীর। সেই নির্যাতনের কষ্ট আর অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে চলা মেয়েটিকে একদিকে দেওয়া হচ্ছিল সর্বোচ্চ চিকিৎসা। অন্যদিকে তার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা ছিল লাখো কোটি মানুষের। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে এক বুক চাপা কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে ছোট্ট শিশুটি। বৃহস্পতিবার (১৩মার্চ) দুপুর একটার দিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, আর কোনো চেষ্টা কাজে আসছে না নির্যাতিত মেয়েটির জন্য।

ছোট্ট মেয়েটির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সমবেদনা জানাতে শুরু করেন। রাজনীতিবীদ, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের পোস্টে মেয়েটির জন্য সমবেদনার পাশাপাশি এমন নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি তুলছেন। কেউ আবার পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে মেয়েটির কষ্টের কথা তুলে ধরে আবেগঘন পোস্ট করছেন।


বিজ্ঞাপন


গণমাধ্যমকর্মী সাজিদা ইসলাম লিখেছেন, ‘সেই ছোট্ট সোনা বাচ্চাটা কত কষ্ট পেল। অবশেষে চলে গেল না ফেরার দেশে। এই দেশে কি বিচার হবে না?’

সিএমএইচের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মেয়েটি একাধিকবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের (হৃদ্‌যন্ত্রের স্পন্দন বা হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাওয়া) শিকার হয়েছে এবং প্রতিবারই সিপিআর প্রদানের মাধ্যমে তাকে স্থিতিশীল করা হয়েছে। এছাড়া, তার রক্তে লবণের ভারসাম্যহীনতার কারণে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে অবশেষে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চীর বিদায় নিয়েছে শিশুটি।

অভিনেতা ইভান সাইর ফেসবুকে মেয়েটির প্রতি সমবেদনা জানিয়ে লিখেছেন, ‘আমাদের মাফ কইরো না মা। আল্লাহর কাছে নালিশ দিও, বিচার দিও।’


বিজ্ঞাপন


সাংবাদিক আমীম ইহসান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মাগুরার শিশুটি কতটা যন্ত্রণা নিয়ে পরপারে চলে গেছে ভাবলে গা শিউরে ওঠে। আমাদের ক্ষমা করো বোন। আমি এর ধর্ষক নরপশুদের সত্যিই ফাঁসি চাই’।

মুজাহিদ শুভ সমবেদনা জানিয়ে লিখেছেন, ‘শেষ হলো ধর্ষকের দেশে ফুলের যাত্রা। আল্লাহর কাছে প্রশান্ত থাকুক শিশুটির আত্মা।’

শিশুটির মৃত্যুর পর এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মাগুরার কয়েকটা নরপশুর নিষ্ঠুরতা তার মতো এক শিশুর ওপর দিয়ে গিয়েছিলো। আর কতটা নিজে এই ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংগ্রাম করে জগতের মায়া ছেড়ে আমাদের লজ্জা দিয়ে ও কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি তার বিদেহী রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। 

যেভাবে নির্যাতনের মুখে পড়লো শিশুটি

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, চার মাস আগে মাগুরা পৌর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে শিশুটির বড় বোনের বিয়ে হয়। ওই বাড়িতে বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাসুর থাকতেন। বিয়ের পর থেকে বড় মেয়েকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন তার শ্বশুর। বিষয়টি পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতেন। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ১ মার্চ বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যায় আট বছরের শিশুটি।

এজাহারে বলা হয়েছে, গত বুধবার (৫ মার্চ) রাত ১০টার দিকে খাবার খেয়ে বড় বোন ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমায় শিশুটি। দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বড় বোন ঘুম থেকে জেগে দেখেন, ছোট বোন পাশে নেই, মেঝেতে পড়ে আছে। তখন শিশুটি বড় বোনকে জানায়, তার যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। কিন্তু বড় বোন মনে করে, শিশুটি ঘুমের মধ্যে আবোলতাবোল বকছে। এরপর সকাল ছয়টার দিকে শিশুটি আবার বোনকে যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়ার কথা বলে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বোনকে জানায়, রাতে দুলাভাই (বোনের স্বামী) দরজা খুলে দিলে তার বাবা (শ্বশুর) তার মুখ চেপে ধরে তার কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করেন। সে চিৎকার করতে গেলে তার গলা চেপে ধরা হয়। পরে তাকে আবার বোনের কক্ষের মেঝেতে ফেলে রেখে যায়।

এই ঘটনায় পরবর্তীতে শিশুটির মা বাদী হয়ে মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৪) এর ক/৩০ ধারায় ধর্ষণ ও ধর্ষণের মাধ্যমে আহত করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই ঘটনা জানাজানি হলে ধীরে ধীরে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদে ফেটে পড়েন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। উচ্চ আদালত থেকে এবং সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত এই ঘটনার বিচার নিশ্চিত করার আশ্বাস দেওয়া হয়।

সব চেষ্টা ব্যর্থ করে পরপারে শিশুটি

গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার বোনের শাশুড়ি। পরে শিশুটির মা হাসপাতালে যান। ওই দিন দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার রাতেই পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শুক্রবার রাতে শিশুটির শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। পরে শনিবার বিকেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) পাঠানো হয়।

সেখানে সিএমএইচের প্রধান সার্জনকে প্রধান করে আটজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা দেয়া হয়। বোর্ডে ছিলেন- সার্জিক্যাল বিশেষজ্ঞ, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ, প্লাস্টিক সার্জন, শিশু নিউরোলজি বিভাগ, অ্যানেসথেসিয়া, শিশু হৃদ্‌রোগ বিভাগ, শিশু বিভাগের সার্জন, ইউরোলজি বিভাগ ও থোরাসিক সার্জন বিভাগের চিকিৎসকেরা।

শুরুর দিকে চিকিৎসক জানান, মেয়েটির গ্লাসগো কোমা স্কেল (জিসিএস) (মস্তিষ্কে আঘাতের কারণে কোনো ব্যক্তির চেতনার মাত্রা পরিমাপ করা হয়) আবারও ৩–এ নেমে এসেছে। স্বাভাবিক মাত্রা ১৫। জিসিএস ৩ অবস্থাকে মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়াহীন অবস্থা বলে বিবেচনা করা হয়।

যে কারণে তার ফিরে আসা নিয়ে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট খুব একই আশার কথা বলতে পারছিলেন না। তবে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হয় বলে সিএমএইচের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

বৃহস্পতিবার মেয়েটির মৃত্যুর কথা জানিয়ে সেনাবাহিনীর ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক পোস্টে বলা হয়, সিএমএইচ-এর সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শিশুটির বৃহস্পতিবার সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, দুইবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃদস্পন্দন ফিরে আসেনি।

কারাবন্দি সব আসামি  

আট বছরের শিশুটিকে ধর্ষণের অভিযোগে মায়ের করা মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অর্থাৎ এই মামলার সব আসামি গ্রেফতার হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, মামলার চার আসামির মধ্যে তিনজন পুরুষের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ইতিমধ্যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার সকালে তিন আসামিকে মাগুরা থেকে ঢাকায় সিআইডির ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবে আনা হয়। একই সঙ্গে শিশুটির ডিএনএ নমুনাও জমা দেওয়া হয়।

বিইউ/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর