পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়। বাস্তবে রূপ নিয়েছে। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিড়ে স্বগৌরবে জানান দিচ্ছে তার মহিমা। পদ্মার দুই পাড়কে এক করেছে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুটি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের বহু আকাঙিক্ষত সেতুটিকে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে নেওয়া হয়ে নানা উদ্যোগ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-নদী শাসন।
সেতুর মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে পদ্মার পাড়ে চলছে নদী শাসনের কাজ। যা পদ্মা সেতুর প্রকল্প এলাকার সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি নদী শাসনের অবকাঠামো ভ্রমণপিপাসুদের নতুন গন্তব্য হয়ে উঠছে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা এলাকায় নেমেছে পদ্মা সেতুর একটি প্রান্তর। নদীর পার সংলগ্ন সেতুর নিচের অংশে এখন চলছে নদী শাসনের কাজ। যা পুরোপুরি দৃশ্যমান। বলা যায় এই অংশে বেশিরভাগ কাজই শেষ হয়েছে। নদী শাসনের জন্য প্রথমে বালিভর্তি বিশেষ জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে নদী পাড়ে। এরপর আগে থেকে সাচে বানিয়ে রাখা চৌকো আকৃতির কংক্রিটের ব্লক একটার পর একটা নদী পাড়ে বিশেষ কায়দায় স্থাপন করা হয়েছে। যা নদীর পাড়ের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
নাওডোবা এলাকার পশ্চিম পাশে নদীর তীর ধরে বহুদূর পর্যন্ত এভাবে নদী শাসন করা হয়েছে। মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে পূর্বে খানিকটা এগোলে চোখে পড়ে নদী শাসনের এমন মনোরম দৃশ্য। প্রতিবছর বর্ষাকালে নদীর এই পাড় ভাঙতো। উত্তাল ঢেউয়ে নদীগর্ভে চলে যেতো বসতবাড়ি, কৃষি জমি। পদ্মা সেতুর উসিলায় নদী শাসন করার পর স্বস্তিতে ওই এলাকার বাসিন্দারা।
নাওডোবা ইউনিয়নের ফকিরের হাটের বাসিন্দা ইদ্রিস মিয়া জানান, বর্ষা এলেই তাদের মনে নদী ভাঙনের আতঙ্ক জাগতো। বহুবছর ধরেই পদ্মার গ্রাসে একটু করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের গ্রাম। নদী শাসনের পর সেই ভয় আর নেই তাদের মনে।
নাওডোবা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। পদ্মা নদীর তীর ঘেঁসে পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়ন। পূর্ব দিকে পালেরচর ইউনিয়ন, পশ্চিমে নাওডবা আর দক্ষিণে সেনেরচর ইউনিয়ন অবস্থিত এবং উত্তরে বিশাল পদ্মা নদী।
বিজ্ঞাপন
পদ্মা নদী সংলগ্ন নাওডোবা একাধিক গ্রামের বাসিন্দারা এই নদীর ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। ফসলের ক্ষেতে পানির সংস্থান, গোসল ইত্যাদি নানা কাজে তারা নতুন তীরে ছুটে আসতেন। নদী শাসনের পর কর্দমাক্ত, বালুময় পাড় এখন শান বাঁধানো ঘাটের রূপ নিয়েছে। ফলে নাওডোবার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ গোসলের জন্য ছুটে আসেন নদীর পাড়ে। অবগাহন করতে ঝাঁপ দেয় প্রমত্তা পদ্মার পানিতে।
পদ্মা পাড়ে নদী শাসন বাঁধ ঘিরে এরইমধ্যে শিবচরের কাঁঠালবাড়ি, মাদবেরচর, চরজানাজাত, পাঁচ্চর ইউনিয়নের পদ্মার পাড় সরগরম হয়ে উঠেছে। এসব এলাকার পদ্মা পাড়ে বাঁধে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ আসছেন দেখতে ও সময় কাটাতে। দূর-দূরান্ত থেকে নদীশাসন বাঁধ দেখতে আসা মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে বাঁধ সংলগ্ন এলাকা। নদী শাসন বাঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে নদীর স্নিগ্ধ বাতাসের ছোঁয়া আর পদ্মার স্বচ্ছ জলে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো- এখন ওই এলাকার মানুষের বিনোদন।
নাওডোবা ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা শরাফত মিয়া বলেন, নদী শাসনের পর থেকে শুক্র, শনিবারসহ ছুটির দিনে নদীর পাড়ে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই পদ্মা সেতু দেখতে আসেন। খুব কাছ থেকে সেতু দেখেন। পাশাপাশি পদ্মা পাড়ের সৌন্দর্যে বিমোহিত হন। সেতুর নিচ দিয়ে খানিকটা এগোলো মঙ্গলমাঝির ঘাট। যেখানে এখন একটি ফেরিঘাট করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের পূর্ব পাশ এটি। এখানেও পুরোদমে এগিয়েছে নদী শাসনের কাজ।
পশ্চিম পাশের মতো এখানেও জিও ব্যাগ, কংক্রিটের ব্লক ফেলে নদীর তীর ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। এই নদী তীরের বড় জায়গা জুড়ে শেখ রাসেল সেনানিবাস, পদ্মা নদী শাসনের কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশনের কার্যালয়। এছাড়াও জাজিরা প্রান্তে যেসব ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকরা কাজ করছেন তাদের থাকার অস্থায়ী আবাসনও এই অংশে। সেজন্য এখানে বেসামরিক লোকজনের চলাচল নিষেধ। কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্বোধন ও নদী শাসন হয়ে গেলে স্থানীয়রা পদ্মা পাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
এদিকে সেতুর মাওয়া প্রান্তের নদী শাসনের কাজও শেষের পথে। ভাঙন কবলিত এই অংশে বালুর বস্তা ও ব্লক ফেলার উপযোগী করতে প্রথমে ড্রেজিং করা হয়েছে। এরপর কংক্রিটের ব্লক বসানো হয়েছে। ফলে ঢাকা থেকে যারা পদ্মা সেতু দেখতে আসছেন তারা পদ্মার পাড়ের এই নদী শাসনের জন্য বিছানো ব্লকের বিশাল জায়গা জুড়ে ঘুরে বেড়ান। ছুটির দিকে এখানে রীতিমতো মেলা বসে। জাজিরা প্রান্তের মতোই সেতুর মাওয়া অংশে নদী শাসন এগিয়েছে দুই দিকে। পূর্ব দিকে শিমুলিয়া ঘাট। পশ্চিমে পুরাতন মাওয়া ঘাট। এই দুই পাশেই নদী শাসনের কাজ শেষের পথে।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে উভয় পাড়ে নদী শাসনের কাজ ৯২ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। সেতুর দুই পাড় মিলে নদী শাসন হচ্ছে ১২ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার চওড়া সেতুটির নির্মাণ কাজ ৭ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে শুরু হয়।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় নয় কিলোমিটার। দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ থাকবে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায়, আরেক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়।
মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) আর নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দুইটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয়েছে এ সেতুর কাঠামো। আগামী ২৫ জুন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ-বিদেশের অতিথিদের নিয়ে উদ্বোধন করবেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
এজেড/এমআর