পদ্মা সেতু। দেশের ২১টি জেলার মানুষের স্বপ্ন। এ যেন পদ্মা নদীকে এক সুতায় বাঁধার মাধ্যম। এতদিন দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে প্রমত্তা নদী পাড়ি দিয়ে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পৌঁছাতে হতো। ঝড়-তুফান উঠলে পদ্মার রূপ বদলে হয়ে ওঠতো ভয়ংকর। নদী পার হওয়ার এমন ঝঞ্জাট যাদের স্মৃতিতে রয়েছে তারাই কেবল বুঝবেন এ সেতুর মর্ম!
পদ্মা সেতুর বিভিন্ন অংশ নিয়ে কথা বললে সবার আগে আসবে এর পিলারের কথা। ৪২টি পিলারই মাটি ও নদীর পানির ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে সেতুর অস্বিত্ব জানান দিয়েছে। এরপর একটার পর একটা পিলারের ওপর বসেছে স্প্যান। পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলারের আদ্যোপান্ত জানুন এই প্রতিবেদনে।
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই দুই পিলার
পদ্মা সেতুর ৪২টি পিলারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ১ ও ৪২ নম্বর পিলার। এই দুইটি পিলার ট্রানজিশন পিলার নামে পরিচিত। এদের উচ্চতা শুনলেও অবাক হবেন। প্রায় ১৩ তলা উঁচু বিল্ডিংয়ের সমান এগুলো।
সেতুর ১ নম্বর ট্রানজিশন পিলারের অবস্থান মাওয়া প্রান্তে। আর ৪২ নম্বর অর্থাৎ দ্বিতীয় ট্রানজিশন পিলারের অবস্থান জাজিরা প্রান্তে। পদ্মা সেতুতে যতগুলো পিলার রয়েছে তার মধ্যে এই দুইটি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। এদের প্রত্যেকটিতে ১৬টি করে পাইল দেওয়া হয়েছে।
এই দুইটি পিলার থেকে সেতুতে ওঠা-নামার সুবিধার্থে তিনটি করে সংযোগ সড়ক বের হয়েছে। এর মধ্যে দুইটি হচ্ছে সড়ক পথ। একটি রেল পথ। সড়ক পথের একটি সেতুতে ওঠার জন্য। আরেকটি সেতু থেকে নামার জন্য। রেল পথ একটিই। এই দুইটি পিলার মূল সেতু এবং সংযোগ সেতুর বন্ধন তৈরি করেছে।
বিজ্ঞাপন
অন্য পিলারগুলোর চাইতে এই দুইটি পিলার দেখতেও আলাদা। এগুলোর ডানা সদৃশ্য কাঠামো রয়েছে। যা সেতুর মূল সড়ক পথের দুই পাশ দিয়ে জেগে উঠেছে।
৬ ও ৭ নম্বর পিলার নির্মাণে জটিলতা
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শুরু হয় পদ্মা সেতুর ৬ নম্বর পিলারের পাইলিংয়ের কাজ। আগের ৫টি পিলার সফলভাবে নদীর বুকে স্থাপন করা হয়েছিল। ৬ ও ৭ নম্বর পিলারে তিনটি করে মোট ছয়টি পাইলের বটম সেকশনের কাজ করা হয়। কিন্তু পাইল বসাতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। নদীর তলদেশে পাওয়া যায় নরম মাটির স্তর। তখন এই দুটি পিলারের ছয়টি পাইলের টপ সেকশনের কাজ বন্ধ রাখা হয়।
সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করে ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাউই ইউকে লিমিটেড। তারা মাটি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করেন। তাদের পরামর্শে এই পিলার দুইটির পাইলের সংখ্যা একটি করে বৃদ্ধি করা হয়। এসব পিলারে খাঁচ কাটা পাইল বসিয়ে তাতে দেওয়া হয় বিশেষ ধরনের সিমেন্টের মিশ্রণ। এর মাধ্যমে নরম মাটি শক্ত করা হয়।
পরবর্তীতে আরও ২০টি পিলারের পাইল বসানোর সময়ও তলদেশে কাদামাটি পাওয়া যায়। মোট ২২ পিলারে ৭টি করে পাইল বসানো হয়। ট্রানজিশন পিলার বাদে বাকি ১৮টি পিলারে দেওয়া হয় ৬টি করে পাইল।
পাইল বসানোই যখন চ্যালেঞ্জ
পদ্মা খুবই খরস্রোতা নদী। এর ওপর সেতু নির্মাণ করা চ্যালেঞ্জিং ছিল। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ ছিল পাইল বসানোকে ঘিরে। নদীর তলদেশে মাটির সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে পাইল বসানো হয়েছে এই সেতুতে। এর আগে পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু নির্মাণে এত গভীরে পাইল বসাতে হয়নি।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাইলিংয়ের নিচে থাকে পাথর ও বালু। কিন্তু পদ্মা সেতুতে ছিল কাদামাটি। তাই এতে পিলার বসানোর কাজটি যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ছিল।
পদ্মা সেতুতে মোট ৪২টি পিলার রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি পিলার নির্মাণ করা হয়েছে নদীতে আর দুইটি নদীর তীরে। নদীতে নির্মাণ করা একটি পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। পিলারের পাইলগুলোর নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যেন মাটির তলদেশে খুঁটিগুলো মাকড়সার জালের মতো একটি কাঠামো তৈরি করে থাকে।
৪২টি পিলারের ওপর বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। যার মাধ্যমে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়। নদীতে প্রতিটি পিলার নির্মাণে ব্যয় হয় ৫ কোটি টাকা। পাড়ের দুইটি পিলার নির্মাণে ব্যয় হয় ৮ কোটি টাকা।
এনএম/এজেড