মঙ্গলবার, ১ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

ধর্ষণের শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড ও অঙ্গ কর্তন!

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশিত: ১০ মার্চ ২০২৫, ০২:৪৮ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

মাগুড়ায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় দেশ বিক্ষোভ প্রতিবাদে উত্তাল। এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি। এই জঘন্য অপরাধে দায়ী ব্যক্তি ও তার সহযোগীদের দেশের আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দাবি করি। যদিও ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের আইনে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা ঘটেনি। এবারের ধর্ষণের ঘটনায় দোষীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত।

আইনের প্রাথমিক নীতি হচ্ছে, ‘অপরাধীর শাস্তি তার দ্বারা কৃত অপরাধের উপযুক্ত হওয়া উচিত।’ কিন্তু ধর্ষককে তার অপরাধের শাস্তি হিসেবে বহু বছরের জন্য কারাগারে প্রেরণ করা এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ধর্ষণের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত ধর্ষকের মধ্যাঙ্গ সমূলে কর্তন করা। এ শাস্তি যদি অতি কঠোর বলে মনে হয়, তাহলে নিদেন পক্ষে ধর্ষকের ‘বল’ বা ‘টেস্টিক্যালস’ বা ‘অণ্ডকোষ’ বা সোজা বাংলায় ধর্ষকের ‘বিচি’ দুটি অপসারণ করা। 


বিজ্ঞাপন


লেখালেখির ক্ষেত্রে আমার গুরু ভারতের পরলোকগত লেখক সাংবাদিক খুশবন্ত সিং ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে বিচি অপসারণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তাতে ধর্ষকের পৌরুষ চিরতরে বিলুপ্ত হবে। সেক্ষেত্রে ধর্ষক উন্মত্ত ‘ষাড় থেকে বলদ’ অথবা ‘পাঠা থেকে খাসি’তে পরিণত হবে। তার পক্ষে আর কখনো ধর্ষণের মতো অপরাধের পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব হবে না। এ ধরনের আইন প্রণীত হলে দেশ থেকে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ দ্রুত হ্রাস পাবে। পুরুষত্ব হারানোর চেয়ে ভয়ঙ্কর ভীতি পুরুষের আর নেই। তারা সমাজে পরিচিত হবে ‘হিজড়া’ হিসেবে। অতএব এই চেষ্টা করায় সমস্যা কোথায়? ধর্ষকের আরেকটি শাস্তি হতে পারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা।

বছর চার বছর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নাইজেরিয়ার কাদুনা স্টেটে এ ধরনের আইনের দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করেছেন। ধর্ষক যদি পুরুষ হলে আইনে তার সাজা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার অণ্ডকোষ অপসারণ করা হয়, ধর্ষক নারী হলে তার ফেলোপিয়ান টিউব বা ‘ডিম্ববাহী নালী’ অপসারণ। ধর্ষিতার বয়স যদি ১৪ বছরের কম হয়, তাহলে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। 

ধর্ষণের বিরুদ্ধে নারী আন্দোলনের চাপে ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলেও এখন পর্যন্ত ধর্ষণের অপরাধে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা জানা যায়নি। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ধর্ষণের অভিযোগের মিমাংসা ঘটে আদালতের বাইরে, প্রভাবশালীদের দ্বারা এবং ধর্ষিতার পরিবারকে কিছু অর্থ দানের মধ্য দিয়ে। গুরু অপরাধে এমন লঘু শাস্তির কারণে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বাধাহীনভাবে ঘটে চলেছে। ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রে’র সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি নয় ঘন্টায় অন্তত একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তাদের ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ৬,২৭২টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞাদের মতে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেক পরিবার ধর্ষিতার তথ্য চেপে রাখে এবং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে তার মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য না করে বরং তাকেই দোষারূপ করে। 

ধর্ষণ ঠেকানোর উপায় কী হতে পারে? ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি সর্বত্র। বেশ কিছু দেশে মৃত্যুদণ্ড এবং দীর্ঘ কারাদণ্ডের বিধান থাকা সত্ত্বেও কোথাও ধর্ষণ থেমে নেই। বহুদিন আগে ‘জখমি আওরত’ নামে একটি হিন্দি মুভি দেখেছিলাম। মুভিতে এক নারী পুলিশ অফিসার তিন ব্যক্তির দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন। বিচার ব্যবস্থা যখন ধর্ষকদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তিনি আরও ক’জন ধর্ষিতার সঙ্গে মিলে ধর্ষকদের খাসী করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনা নেন। তারা এক নারী চিকিৎসকের সহায়তা নিয়ে তিন ধর্ষককে এক এক করে ফাঁদে ফেলে প্রত্যেককে খাসী করে প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করে। বিচার ব্যবস্থার ওপর ভুক্তভোগীর আস্থা উঠে গেলে তারা যদি আইন হাতে তুলে নেয়, তাহলে কী অন্যায় হবে? ধর্ষণের শিকারকে জীবনভর জ্বলন্ত নরকে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে নিদেনপক্ষে ধর্ষকের বিচি অপসারণ খুব গুরুতর অপরাধ হবে না। 


বিজ্ঞাপন


দেশে দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান:

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধর্ষণের মতো শয়তানি অপরাধ নির্মূল অথবা হ্রাস করে বা শাস্তির কঠোরতার ভীতি জাগিয়ে রেখে দেশকে নাগরিকদের জন্য নিরাপদ রাখতে সচেষ্ট। আফগানিস্তানে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে ধর্ষককে পাকড়াও করার পর চার দিনের মধ্যে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সৌদি আরবে ধর্ষককে প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদ করা হয়। ভারতে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে ধর্ষকরা ২-৩ বছরের মধ্যে জামিন পেয়ে যায়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে ভারতে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। চীনে ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং কিছু ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ কর্তন। রাশিয়ায় ধর্ষণের শাস্তি ভূক্তভোগীর ক্ষতি বিবেচনায় ৩ বছর থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষণের মতো অপরাধে কোনো ধরনের ক্ষমাশীলতার সুযোগ নেই। ধর্ষকের শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড। 

যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের শাস্তি দুই ধরনের আইনে হতে পারে- স্টেটের আইন ও ফেডারেল আইনে। অতএব দেখা যায়, অনেক ধর্ষক জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ৩০ বছরের কারাদণ্ড লাভ করছে। নরওয়েতে ধর্ষকের সাজা ৪ থেকে ১৫ বছর। ইসরায়েলে ধর্ষণের জন্য দাষী ব্যক্তির শাস্তি ৪ থেকে ১৬ বছরের কারাদণ্ড। ফ্রান্সে ১০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত; ইরানে মৃত্যুদণ্ড; সংযুক্ত আরব আমিরাতে মৃত্যুদণ্ড। 

যেকোনো অপরাধ বা আইনবহির্ভূত কাজের জন্য শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও অপরাধীরা শাস্তির ভয়ে অপরাধ করেনি, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড বিশ্বের প্রায় সব দেশে চালু ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাািধকার সংস্থগুলো চাপ, দেনদরবারে ১৪৪টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করে হত্যার দায়ে অভিযুক্তদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিচ্ছে। ৫৫টি দেশে এখানো মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। কিন্তু শাস্তির কঠোরতা বা নমনীয়তার কারণে অপরাধীদের দ্বারা অপরাধ ঘটানো কমলেও অপরাধীর মনোজগত থেকে অপরাধ দূর হয় না।
 
ধর্ষণের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশের মতো চিরউচ্ছৃঙ্খল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ও যৌন অবদমিত দেশে সুযোগ সন্ধানী ধর্ষকের যদি তার অসহায় শিকারের ওপর জবরদস্তি প্রয়োগের, ফুসলানোর বা বেকায়দায় ফেলার সুযোগ আসে, তাহলে তার লাম্পট্য চেগিয়ে উঠে। তার শিকারের যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয় তা তার পক্ষে জীবনে কখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে দেখা যায়, ধর্ষিতরা বেশির ভাগ ধর্ষককে জানে। তারা আশপাশের মানুষ, এমনকি আত্মীয়স্বজনের মধ্যে গণ্য। অতএব জানাজানি হলে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ও চাপ থাকে আপসের। ধর্ষণের ক্ষেত্রে আপসের এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা সত্বেও ধর্ষণের হার কমবে না। 

ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এর হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের ধর্ষণ বিষয়ক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বের অন্তত ৩৫ শতাংশ নারী তাদের জীবনে কখনো না কখনো যৌন হয়রানির কবলে পড়েছেন। কিন্তু জাতিসংঘের  তথ্যউপাত্ত অনুযায়ী এমন দেশও আছে যেখানে ৭০ শতাংশ নারী তাদের ঘনিষ্ট পুরুষ সঙ্গী দ্বারা শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণ ও বিচার:

আমি যেহেতু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি, অতএব ‘মানবাধিকারের এই মহান দেশে’ ধর্ষণ চিত্র তুলে না ধরা সঠিক হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে ধর্ষণের হার ২৭.৩ শতাংশ। আগেই উল্লেখ করেছি যে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের দায়ে শাস্তি সর্বোচ্চ ৩০ বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু এখানে আইনের প্রয়োগ ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেঁড়ো’র মতো। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এর উপাত্ত অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে ৯ শতাংশ ধর্ষকের বিচার হয়, যার মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ সাজা পায়, অবশিষ্ট ৯৭ শতাংশ ধর্ষক অবাধে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। এদেশে ৭০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ভুক্তভোগীর পরিচিত পুরুষ দ্বারা।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রখ্যাত সাংবাদিক।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর