বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

পদ্মা সেতু: কৃষিতে সোনালী সম্ভাবনার হাতছানি

ড. মো. আনোয়ার হোসেন 
প্রকাশিত: ২৫ জুন ২০২২, ০৯:৪৩ এএম

শেয়ার করুন:

পদ্মা সেতু: কৃষিতে সোনালী সম্ভাবনার হাতছানি
ছবি: ঢাকা মেইল

স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। চোখের সামনে দৃষ্টিসীমানায়দৃঢ় বাস্তব চোখ ধাঁধানো অবকাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সোনালী সম্ভাবনার হাতছানি। প্রতীক্ষা শেষ। এখন অপেক্ষায় উদ্বোধনের। পদ্মা সেতু তৈরির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা মতে— দেশের সার্বিক জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে পদ্মা সেতু। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। সেতুর জন্য করা নদী-শাসন পদ্মার ভাঙন প্রবণতা কমাতেও ভূমিকা রাখবে। যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাড়বে শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ, গতি পাবে নগরায়ণ, কৃষিতে আসবে নতুন বিপ্লব, বাড়বে কর্মসংস্থান, বিকশিত হবে পর্যটন এবং হ্রাস পাবে দারিদ্র্যতা। 

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো এতদিন রাজধানী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। পদ্মা সেতুর উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতে উন্নত প্রযুক্তির বিস্তার এবং বাজার অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করা যায়। পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এই সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতুতে পরিণত হয়েছে। 


বিজ্ঞাপন


পদ্মা সেতুর মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি; ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী এবং খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। এই ২১ জেলায় দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। দীর্ঘদিনের অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৪ কোটি মানুষের সঙ্গে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ এই সেতুর সুফল ভোগ করবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারত, ভুটান, নেপাল ও মায়ানমারের সঙ্গে এ দেশের সড়ক ও রেল সংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপকভিত্তিক প্রসার ঘটবে। 

দেশের বৃহত্তম এবং প্রকৌশল খাতের বিস্ময় এই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু শুধু বিশ্ব দরবাবে বাংলাদেশকে অনন্য মর্যাদায়ই আসীন করেনি বরং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা সমূহে বিশেষ করে খুলনা এবং বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক কৃষি এবং ছোট ব্যবসাকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করে অর্থনৈতিক ও দারিদ্র্য হ্রাসেও প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া অসংখ্য সরকারি ও বেসরকারি শিল্পের প্রসার, উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাতকরণ, কৃষি পণ্য, মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদকে দ্রুততম সময়ে মূলধারার বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। শিল্প প্রসারের অন্যতম নিয়ামক হলো কাঁচামাল সরবরাহ সহজলভ্য করা এবং উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাত করা। পদ্মা সেতু পার হয়েই ভাঙ্গা উপজেলা। যার তিন দিকে তিনটি রাস্তা -একটি বরিশাল, একটি খুলনা এবং অন্যটি রাজবাড়ী, যশোর ও বেনাপোলকে সংযুক্ত করেছে। তিনটি সড়ক মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমদানি পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় সরবরাহ করা সম্ভব হবে। মূলকথা এ সেতুটি ভবিষ্যতে ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে মংলা ও পায়ারা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালি স্বপ্ন এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয় যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পদ্মা সেতু এক্ষেত্রে অর্থনীতির ভিত্তি ও সোনালি সোপান হিসেবে কাজ করবে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত।

বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী চির সবুজ অনুপম ঐশ্বর্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের অধিকাংশ নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এই অঞ্চল মূলত পলি মাটি দ্বারা গঠিত। এই এলাকার মানুষের প্রধান আয়ের উৎস হলো ধান, মাছ ও বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ। অন্যদিকে এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ নারকেল ও সুপারি জন্মে। এই এলাকার দক্ষিণাংশ নিচু ভূমি এবং লবণাক্ততা যুক্ত। বাকি অধিকাংশ সমভূমি। এই লবণাক্ত এলাকায় ফসল উৎপাদনের বিষয়টি একসময় কল্পনাও করা যেত না। আর এখন সেই উপকূলীয় এলাকায় পতিত লবণাক্ত জমিতেই আবাদ হচ্ছে তরমুজ, সরিষা, লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধান, পাট, গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ভুট্টা, ঘেরের আইলে আগাম শিম, ডাল, আলু, ভুট্টা, বার্লি, সূর্যমুখী, শাকসবজিসহ অনেক ফসলের লবণাক্ততাসহিষ্ণু উন্নত জাত। 


বিজ্ঞাপন


তথ্য মতে, দেশের মোট অনাবাদি ৮৪ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ বিদ্যমান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। এ জমির প্রায় অর্ধেকই লবণাক্ত। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ ১৯৭৩ সালে ছিল প্রায় ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর যা বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর। গত এক দশকের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর। এই লবণাক্ত জমিকেই আনা হচ্ছে চাষাবাদের আওতায়। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হলে কৃষক চাষাবাদে আরও আগ্রহী হবে এবং বৃদ্ধি পাবে কৃষির উৎপাদন। 

ধান ব্যতিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের জেলাসমূহের প্রধান প্রধান ফসলগুলো হলো বরিশাল- গম, ভুট্টা, আলু, ছোলা, মশুর, সয়াবিন, পাট; পিরোজপুর- আলু, মুগ; ভোলা- গম, ভুট্টা, আলু, মশুর, সরিষা, মুগ, সয়াবিন, পাট; পটুয়াখালী- ভুট্টা, আলু, ছোলা, মশুর, সরিষা, মুগ, সূর্যমুখী; বরগুনা- আলু, চীনাবাদাম, মুগ; ঝালকাঠি- আলু, মুগ; খুলনা বিভাগের জেলাসমূহের প্রধান প্রধান ফসলসমূহ হলো খুলনা- মশুর, পাট; বাগেরহাট- মশুর, পাট; যশোর- গম, ভুট্টা, আলু, চীনাবাদাম, মশুর, লিচু, পাট; সাতক্ষীরা- গম, আলু, মশুর, পাট; নড়াইল- গম, মশুর, সরিষা, পাট; কুষ্টিয়া- গম, ভুট্টা, আলু, ছোলা, চীনাবাদাম, মশুর, আম, লিচু, পাট, পিয়াজ; মেহেরপুর- গম, ভুট্টা, আলু, মশুর, সরিষা, মুগ; চুয়াডাঙ্গা- গম, ভুট্টা, আলু, মশুর, পাট; ঝিনাইদহ- গম, ভুট্টা, আলু, চীনাবাদাম, মশুর, সরিষা, মুগ, পাট, পিয়াজ; মাগুরা- গম, মশুর, সরিষা, পাট, পিয়াজ; এবং ঢাকা বিভাগের জেলাসমূহের প্রধান প্রধান ফসলসমূহ হলো গোপালগঞ্জ- গম, চীনাবাদাম, মশুর, সরিষা, পাট; মাদারীপুর- গম, ছোলা, চীনাবাদাম, মশুর, সরিষা, পাট; শরীয়তপুর- গম, আলু, মশুর, সরিষা, পাট; রাজবাড়ী- গম, মশুর, সরিষা, মুগ, পাট, পিয়াজ। এসব জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উপকূলবর্তী বিপুল এলাকার সকল চাষীদের মধ্যে দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য রোডম্যাপ প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান আছে।

একটা সময় বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল ফলানোর কথা ভুলতেই বসেছিল আমাদের উপকূলীয় এলাকার কৃষকরা। নানাবিদ গবেষণা এবং সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রমের ফলে পাল্টে গেছে লবণাক্ত এলাকার কৃষি উৎপাদনের সার্বিক চিত্র। একটা সময় দেশের দক্ষিণাঞ্চল মানেই যেন ছিল সারি সারি চিংড়ি ঘের। দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে সারা বছরে একটি ফসল হতো। আমন ধান তোলার পর বছরের বাকি সময়টা মাঠের পর মাঠ জমি অলস পড়ে থাকত। এই প্রতিকূল ও বিরূপ পরিবেশে বছরে কীভাবে দুইবার বা তিনবার ফসল চাষ করা যায়- সেলক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে কিছুটা সফলতাও এসেছে। পদ্মা সেতু উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে কৃষক তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে পারবে। ফলে দেশের খাদ্যভাণ্ডার খ্যাত এই এলাকার সবুজ বিপ্লব আরও ত্বরান্বিত হবে। ধানের ঘাত সহিঞ্চু ও উচ্চ ফলনশীল নতুন জাতগুলোর দ্রুত বিস্তার ঘটবে। ফলে চাল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া বিস্তীর্ণ চরের নারিকেল, সুপারি, সমতলের পান, তেজপাতা, বিভিন্ন ডাল, তরমুজ এমনকি ফুলের বাণিজ্যিকভাবে চাষ বৃদ্ধিপাবে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টন কৃষিপণ্য রাজধানীতে নেওয়া হয়। এই উৎপাদন চিত্র তথা ফসলের নিবিড়তা আরও সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করা যায়- যার ফলে এ এলাকায় সারা বছর কোনো না কোনো ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। আধুনিকায়ন ঘটবে কৃষিতে। যার মাধ্যমে টেকসই হবে সার্বিক কৃষি ব্যবস্থা। 

ড. মো. আনোয়ার হোসেন 
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা 
ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
গাজীপুর-১৭০১।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর