মানুষের জীবনে ধর্ষণ সবচেয়ে কলঙ্কময়, নিকৃষ্টতম অপরাধ। এই অধ্যায়ে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সভ্যতার চাদরে নিজেদের মুড়িয়ে নারীদের আশপাশেই থাকে। তারা এমনই সাইকোপ্যাথ, এতে তাদের বিন্দুমাত্র মানসিক হিতাহিতজ্ঞান বা অপরাধবোধ কাজ করে না। নারীরা তাদের আপনজন বন্ধু কিংবা বাবা ভাইয়ের সমবয়সী সমতুল্য ভেবে ভরসা করে বিশ্বাস করে ঠকে যায়। ফলশ্রুতিতে কেউ কেউ সুন্দর পৃথিবীকে ঘৃণা করে জীবনের কাছেই হেরে যায়।
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে অন্যায় অপরাধমূলক কার্যক্রম বেড়েছে। মব জাস্টিস, মোরাল পুলিশিং, সাইবার বুলিং বিশেষ করে অনলাইন হোক বা অফলাইন, নারীদের শ্লীলতাহানি দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে এই অপরাধ কমে আসবে বলে আমি আশাবাদী।
বিজ্ঞাপন
উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার মধ্যে যেই ৭ বছরের শিশুটি মৃত্যুমুখে কাতরাচ্ছে, তার প্রতিচ্ছবিই আজকের বাংলাদেশ। এই চপেটাঘাতের দায় থেকে কোনোভাবেই নিজেদের মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। তার মতো যারা আছে, তাদের জন্য কিছু না করতে পারার অপারগতা, যত দ্রুত সম্ভব প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারলে এ লজ্জা পুরো জাতির কাঁধে নিতে হবে।
২০২৫ সালে এসেও তৃতীয় শ্রেণির শিশুটির জন্য সুন্দর সুরক্ষিত পৃথিবী উপহার দিতে পারছি না। সেই পরিবেশ তৈরি করা তো দূরের কথা, আরও সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি না। কতজনের ঘরের ভেতরেই ধর্ষক ঘুমায়। যার কাছে তার পুত্রবধূ, তার নাতনিসম শিশুটি নিরাপদবোধ করার কথা, তার কাছেই সে রাক্ষস দৈত্য দানব হয়ে হানা দেয়।
আমি নারী। আমি নিজেরসহ দেশের শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল নারী সমাজের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হোক চাই। পরিবার থেকেই নারী শিশুদের গুড/ব্যাড টাচ কি, ট্যাবু ভেঙে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করলে, ছেলেদের নৈতিক শিক্ষা দিলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই সচেতনতা সম্মানবোধের মানসিকতা তৈরি করা সম্ভব।
২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক উদ্যোগে যুক্ত আছি, যুব সমাজকে সঠিক পথে সুস্থ ধারায় এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করছি। কয়েক লাখ মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি। সেই সঙ্গে সভ্যতা বিনির্মাণেও ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সমাজে এগিয়ে যেতে নিলে প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সকলের পজিটিভ রেসপন্স খুব প্রয়োজন।
বিজ্ঞাপন
না বললেই নয়, ধর্ষণ নতুন কোনও ঘটনা নয়। আমরা সেটিকে প্রতিহত করতে যেন ব্যর্থ না হয়ে পড়ি। ২০১৬-২০১৭ তে গণপরিবহনে যৌন হয়রানি এবং বেশকিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গণপরিবহনে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকলেও সেখানে নিরাপদে চলাচল করতে পারত না নারীরা। বিভিন্ন প্রকার বুলিং, ইভটিজিং ও হ্যারাসমেন্টের শিকার হতো তারা। নারীদের নিরাপত্তা ও প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের নারী দিবস উপলক্ষ্যে ডু সামথিং এক্সেপশনাল (ডিএসই) উদ্যোগ নেয় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর প্রচার প্রসার ঘটানোর। যেখানে ঢাকাকে ১০টি জোনে ভাগ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহায়তা ও নাইওরীর পৃষ্ঠপোষকতায় গণপরিবহনে ১০ হাজার সচেতনতা মূলক স্টিকার এবং যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ এ ফোন করার প্রচারণা চালানো হয়।
সাড়ে চার লাখ সদস্যদের উৎসাহ উদ্দীপনা এই কাজে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। কিছুদিনের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাদেশে ৯৯৯ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেটি চলমান রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা যায়নি।
যদি ৯৯৯ জাতীয় জরুরি সেবা গ্রামগঞ্জে ঘরে ঘরে বাটন ফোনেও পৌঁছে দেওয়া যায় এবং তড়িৎ সেবা প্রদান ও শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, এ ধরনের অপরাধ ও প্রবণতা কমে আসবে বলে ধারণা করছি।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ আধুনিক হচ্ছে। ইন্টারনেটকে অভিশাপ নয় আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাছেও সহজলভ্য হয়ে উঠুক এটি। এর জন্য ধর্মীয় আচার, সামাজিক মূল্যবোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প নেই। সমাজব্যবস্থা যেন প্রতিবন্ধক না হয়, একে অন্যের সহায়ক পরিপূরক হতে হবে। পাশাপাশি দ্রুত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক।
বিভিন্নভাবে নারীরা প্রতিনিয়ত হ্যারাস হচ্ছে। তারা সেটা সচেতনতার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় পাবলিকলি পোস্ট করলে তাদের যে ভিকটিম ব্লেমিং করা হয়। বডি শেমিং করা হয়, বাধ্য হয়ে তারা একটা সময় ধৈর্যহারা হয়ে লোকলজ্জায় পোস্ট মুছে দেয় বা চুপ হয়ে যায়।
কিন্তু এসব মানুষ যেন সাইবার নিরাপত্তা পায়, প্রতিবাদ বিমুখ যেন না হয়ে পড়ে সেটা সবার আগে ভাবতে হবে। নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যে যেন বিপরীত প্রভাব না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এটি সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি। আত্মরক্ষার জন্য অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস যোগাতে হবে। তাদের আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিতে হবে। তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সহজ করে দিতে হবে। শুধু সরকার প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রের নয়, সাধারণ জনগণের দায়িত্ব নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
নারীর প্রতি সম্মান মর্যাদা মুখে নয়, কাজে ফুটে উঠুক। পরিবেশ-সমাজ আর্থিকভাবে উন্নত হওয়ার দেশের মানুষের মন-মস্তিষ্ক মানসিকভাবে বিকশিত হোক।
একটা প্রশ্ন রেখে যাই যে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান একজন বিজ্ঞ-বিচক্ষণ ব্যক্তি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রী নারী, সেখানে প্রতি মুহূর্তে নারীরা আতঙ্ক থাকবে কেন? উত্তর কে দেবে?
লেখক: সমাজকর্মী (পরিচালক- ডু সামথিং এক্সেপশনাল (ডিএসই)