পদ্মা সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহা-কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয় এটি আমাদের অহংকার, গর্ব, সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, এই সেতু দেশের জনগণের। এই সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়। সেতুর ৪২টি স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
বিজ্ঞাপন
বুধবার (২৯ জুন) জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য বেগম মেরিনা জাহানের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ষড়যন্ত্রের ফলে আমাদের সেতু নির্মাণ দুই বছর বিলম্বিত হয়েছে, কিন্তু আমরা হতোদ্দম হইনি। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর মুখ দেখেছি। পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, পারেনি। আমরা বিজয়ী হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চল বিশেষ করে উত্তর-মধ্যাঞ্চলের সড়ক ও রেল যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। এর ফলে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি হবে, যা দেশের পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে সাহায্য করবে এবং কৃষি, ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। পদ্মা সেতু শুধু পরিবহন খাতে নয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে জাতীয় ৩২ আঞ্চলিক অর্থনীতির বিস্তৃত ক্ষেত্রেও প্রভাব সৃষ্টি করবে। অধিকন্তু এ সেতু পদ্মা নদী দ্বারা বিভক্ত দেশের দু'টি অঞ্চলকে একীভূত করে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক এবং সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে। দেশের উন্নয়নে পদ্মা সেতু বিভিন্নভাবে অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
সরকারপ্রধান বলেন, সেতু নির্মাণের সময় যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয়েছে এবং এর অগ্রবর্তী ও পশ্চাৎ (সংযোগ হিসেবে যে সকল কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার মাধ্যমে ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে অনেক সম্পদের সঞ্চালন হয়েছে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে অর্থনীতিতে নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য আসবে। এর মাধ্যমে শুধু যে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে তা নয়, পাশাপাশি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন সঞ্চালনের মতো নানাবিধ সুবিধা যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সেতুটি উক্ত অঞ্চলের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
বিজ্ঞাপন
সংসদ নেতা বলেন, পদ্মা সেতু চালুর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১.২৩ শতাংশ বাড়বে এবং দারিদ্র্যের হার প্রতিবছর শতকরা ০.৮৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসহ বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় সারাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠার পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং নতুন নতুন অর্থনৈতিক করিডোর স্থাপনের উপযোগিতা তৈরি হবে। ফলে এ সেতু চালু হলে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে সৃষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একদিকে যেমন বেকারত্ব হ্রাসে ভূমিকা পালন করবে তেমনি দারিদ্র্য দূরীকরণেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এছাড়াও সরাসরি সড়ক ও রেল যোগাযোগের ফলে সাধারণ মানুষের বিপুল কর্মঘণ্টার সাশ্রয় হবে এবং জীবনমান উন্নত হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সুষ্ঠু ও সরাসরি যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং ২০০১ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। উক্ত সমীক্ষায় কারিগরি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য এবং উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা নদীর ওপর ৪ লেনবিশিষ্ট সড়ক ও রেলসহ সেতু নির্মাণের সুপারিশ করে। এর ভিত্তিতে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়াপয়েন্টে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে মাওয়া প্রান্তে সেতু নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং জাপান সরকারকে পুনরায় মানিকগঞ্জের আরিচা প্রান্তে পদ্মা সেতুর জন্য সমীক্ষা করতে বলে। দ্বিতীয়বার সমীক্ষার পর জাপান মাওয়া প্রান্তকেই নির্দিষ্ট করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিবেদন পেশ করে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করি। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সেতুর বিস্তারিত ডিজাইন প্রণয়নের লক্ষ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে বিস্তারিত ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন স্বাক্ষরিত হয়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি ষড়যন্ত্রের ঠিকাদার নিয়োগে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হলে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজের নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা এবং আইডিবি ঋণচুক্তি স্থগিত করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে কানাডার টরেন্টোর একটি আদালতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে পুনরায় ফিরে আসার ঘোষণা দিলেও দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণ না করে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। বহু কাঙিক্ষত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সূচনালগ্নে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, চ্যালেঞ্জসমূহের উত্তরণ এবং হার না মানা সুদৃঢ় মনোবলের মাধ্যমে সব প্রতিকূলতাকে জয় করে এ সেতু আজ স্বপ্ন নয়, একটি দৃশ্যমান বাস্তবতা।
দেশি ও বিদেশি সব ষড়যন্ত্র এবং বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। গত ২৫ জুন ২০২২ স্বপ্নের পদ্মা সেতু শুভ উদ্বোধন করা হয়েছে। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে লাখো শুকরিয়া জানাই। এতে কোটি কোটি দেশবাসীর সঙ্গে আমিও আনন্দিত, গর্বিত এবং উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ বহু-কাঙ্ক্ষিত সেতু দাঁড়িয়ে গেছে।
টিএ/এমআর