শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

ভেজালমুক্ত কোরবানির পশু ও বিড়ম্বনাহীন হাটের উদ্যোগ

কৃষিবিদ সামছুল আলম
প্রকাশিত: ২২ জুন ২০২৩, ০৮:৫৯ পিএম

শেয়ার করুন:

ভেজালমুক্ত কোরবানির পশু ও বিড়ম্বনাহীন হাটের উদ্যোগ

একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর জন্য ভারত, মিয়ানমার ও নেপালের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু আসা অনেকটাই কমে গেছে। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে কোরবানির পশু নিয়ে ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছিল। মূলত তখন থেকেই বাংলাদেশ সরকার ও খামারিরা উপলব্ধি করে যে দেশের ভেতরেই গবাদি পশুর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তখন থেকেই প্রাণিসম্পদ খাতে সরকারের প্রচেষ্টা এবং খামারি ও গবেষকদের অবদানেই আজ বাংলাদেশে কোরবানির পশুর জন্য পরনির্ভরশীলতা কমে এসেছে। এমনকি গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির পশু উদ্ধৃত থাকছে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ বছর কোরবানির জন্য ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি পশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে গরু-মহিষ ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২টি, ছাগল-ভেড়া ৭৬ লাখ ৯০ হাজারটি এবং অন্যান্য পশু রয়েছে ২ হাজার ৫৮১টি। কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫৪টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ লাখ ৫৩ হাজার ১২৮টি, রাজশাহী বিভাগে ৪৫ লাখ ১১ হাজার ৬১৪টি, খুলনা বিভাগে ১৫ লাখ ১১ হাজার ৭০৮টি, বরিশাল বিভাগে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ২০৬টি, সিলেট বিভাগে ৪ লাখ ১০ হাজার ২২৫টি, রংপুর বিভাগে ১৯ লাখ ৬২ হাজার ৯৫১টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭টি পশু রয়েছে। এ বছর কোরবানির জন্য প্রয়োজন হবে ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি পশু। অর্থাৎ চলতি বছর কোরবানির পশু উদ্ধৃত থাকবে ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪টি।


বিজ্ঞাপন


এখন পশু উদ্ধৃত থাকলেও ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে ভেজাল (অর্গানিক নয়) পশু নিয়ে। ভালো দাম পাওয়ার আশায় প্রতি বছর কোরবানির ঈদ সামনে রেখে একদল অসাধু ব্যবসায়ী গরু মোটা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করেন। এতে গরুর শরীরে অতিরিক্ত পানি জমতে শুরু করে। ফলে গরুর কিডনি, ফুসফুস, পাকস্থলী ও যকৃত নষ্ট হতে থাকে এবং গরুটি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যায়। পশুকে স্টেরয়েড বা হরমোন প্রয়োগ করা হলে তা পশুর প্রস্রাব বন্ধ করে দেয়। ফলে পশুর চামড়ার নিচে পানি জমতে থাকে এবং পশুর শরীরের সেলগুলো ফুলে যাওয়ায় পশুকে স্বাস্থ্যবান দেখায়। এই প্রক্রিয়া পশুর জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ওই পশুর মাংস যারা খায় তাদের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। যদিও মৎস্য খাদ্য ও পশু খাদ্য আইনের ধারা ১৪ তে বলা হয়েছে, গবাদিপশুর হৃষ্টপুষ্টকরণে কোনোপ্রকার হরমোন, স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশে গরু মোটাতাজাকরণ দুটি ভাগে করা হয়। একটি রেগুলার, অন্যটি সিজনাল। এরমধ্যে সিজনাল অর্থাৎ ঈদ সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণের প্রবণতা বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণিদেহে স্টেরয়েড বা ওষুধের কার্যকারিতা শুরু হতে ৫-৬ ঘণ্টা লাগে। তবে এসব ওষুধ ছাড়া বৈজ্ঞানিক উপায়ে গরু মোটাতাজা করতে হলে কমপক্ষে ৯০ থেকে ১২০ দিন আগে থেকে গরুর লালন-পালন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ভোক্তাদের মাঝে ভেজালমুক্ত কোরবানির পশু সরবরাহ করতে সরকারি পর্যায়ে ইতোমধ্যে বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলায় কর্মরত কর্মকর্তাগণ খামারিদের নিরাপদ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রশিক্ষণে স্টেরয়েড/হরমোন অপপ্রয়োগের কুফল সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং খামারিরা তদানুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন। উল্লেখ্য, চলতি বছরে ৭২ হাজার ৫৬৩ জন খামারিকে গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

তাছাড়াও অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এধরনের ভেজাল(ক্ষতিকর উপায়ে মোটাতাজাকরণ) পশু নির্ধারণ করতে ও অন্যান্য সেবা দিতে সারাদেশে ৩ হাজার ১৯৫ টি কোরবানির পশুর হাট বসবে। বিশেষকরে রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৯ টি অস্থায়ী ও ২ টি স্থায়ী হাট মিলে মোট ২১ টি হাট বসবে। এসব হাটে দায়িত্ব পালন করার জন্য ১ হাজার ৬২৩ টি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের সেবা প্রদানের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের জন্য অ্যাপ্রোন, মাক্স, চেয়ার-টেবিল, বালতি, মগ ইত্যাদি সরবরাহ করাসহ নিরাপদ খাদ্য/মাংস সম্পর্কিত স্লোগান সম্বলিত টি-শার্ট, ক্যাপ, পোষ্টার, লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুনসহ ভেটেরিনারি ক্যাম্প সু-সজ্জিতকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম এর কার্যক্রম মনিটরিং এর জন্য কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিম এবং বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে। বিশেষ করে কোরবানির পশুর হাট ব্যবস্থাপনার জন্য ৬টি মনিটরিং টিম ও কন্ট্রোল রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কোরবানিযোগ্য পর্যাপ্ত পশু থাকলেও একশ্রেণীর অসাধু, অতিমুনাফালোভী কারবারি নানাভাবে পশুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করে। এতে করে ভোক্তা পর্যায়ের সাধারণ মানুষ নানা ভোগান্তির শিকার হয়। অন্যদিকে সাধারণ ছোট ছোট খামারিরাও ক্ষতির সম্মুখীন হন। এসব ক্ষতির হাত থেকে খামারিদের রক্ষা করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব উদ্যোগের একটি হলো অন্যান্য বছরের মতো এবারও রেলে কোরবানির গবাদিপশু পরিবহন করা হবে। যে অঞ্চলে গবাদিপশুর উৎপাদন বেশি সে অঞ্চল থেকে যে অঞ্চলে উৎপাদন কম সে অঞ্চলে রেলের মাধ্যমে পশু পরিবহন করা যাবে। এক্ষেত্রে রেল বিশেষ সুযোগ দেবে। কম খরচে পশু পরিবহনের সুযোগ করে দেবে। দেশের সর্বত্র যাতে কোরবানির পশু পর্যাপ্ত থাকে সে অনুযায়ী পশু পরিবহনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।


বিজ্ঞাপন


তাছাড়া খামারিরা যাতে পছন্দ অনুযায়ী হাটে কোরবানির পশু বিক্রি করতে পারে এবং জোর করে কেউ পথে পশু নামাতে না পারে সেজন্য খামারিরা চাইলে ৯৯৯ এ যোগাযোগ করতে পারবে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এবার সরকারি নির্দেশনা রয়েছে, কেউ খামারে পশু বিক্রি করলে তার কাছ থেকে হাসিল আদায় করা যাবেনা। কোনো খামারি নিজ বাড়ি থেকে পশু বিক্রি করলেও তাকে হাসিল দিতে হবে না। হাটে আনার পথে কেউ পশু বিক্রি করলে তার কাছ থেকে ইজারাদার জোর করে চাঁদা বা হাসিল আদায় করতে পারবে না। পশুর যেন কৃত্রিম সংকট না হয়, সেজন্য হাটে আনার পথে, বাড়িতেও পশু বিক্রি করা যাবে। তবে রাস্তায় হাট বসানো যাবে না। এছাড়া ডিজিটাল হাটের মাধ্যমেও পশু বিক্রি করা যাবে। সকল সিটি কর্পোরেশন ডেইরী ফার্মার্স এসোসিয়েশন এবং ই-কমার্স এসোসিয়েশন/গ্রুপের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে অনলাইন গবাদিপশু বেচা-কেনার উদ্যোগে সহযোগিতা প্রদান করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে সুস্থ ও অসুস্থ গরু চিনতে পারবে সে ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্নভাবে বার্তা প্রচার করে যাচ্ছেন। এসব বার্তার মাধ্যমে কোরবানির পশুর হাটে একজন ক্রেতা সহজেই বুঝতে পারবে গরুটি সুস্থ না কি অসুস্থ। প্রথমত, রাসায়নিক বা ওষুধ দেওয়া গরুর মাংসপেশি থেকে শুরু করে শরীরের অন্য অঙ্গগুলো অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়। গরুর শরীরে পানি জমার কারণে বিভিন্ন অংশে চাপ দিলে সেখানে গর্ত হয়ে দেবে যাবে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় নেবে। দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত ওজন হওয়ায় এসব গরু স্বাভাবিক নড়াচড়া ও চলাফেরা করতে পারে না ও শান্ত থাকে। রাসায়নিকযুক্ত গরু ভীষণ ক্লান্ত থাকে ও ঝিমাবে। আর সুস্থ গরুর গতিবিধি চটপটে থাকে। কান ও লেজ দিয়ে মশা মাছি তাড়াবে। তৃতীয়ত, সুস্থ গরুর নাকের ওপরের অংশটা ভেজা বা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা থাকবে। অন্যদিকে অসুস্থ গরুর নাক থাকবে শুকনা। ভেজাল ওষুধ খাওয়ানো গরুর শরীরের অঙ্গগুলো নষ্ট হতে শুরু হওয়ায় এগুলো শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত নেয়, মনে হবে হাঁপাচ্ছে। চতুর্থত, অতিরিক্ত স্টেরয়েড দেওয়া গরুর মুখ থেকে প্রতিনিয়ত লালা ঝরে। এসব গরু কিছু খেতে চায় না। অন্যদিকে সুস্থ গরুর শরীরের রঙ উজ্জ্বল, পিঠের কুঁজ মোটা, টান টান ও দাগমুক্ত হবে। সুস্থ গরুর রানের মাংস শক্ত থাকবে। আর রাসায়নিক দেওয়া গরুর পা হবে নরম থলথলে হবে। পঞ্চম লক্ষণ হলো, যদি গরুর শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় (১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর) তাহলে বুঝবেন গরুটি অসুস্থ। ষষ্ঠ লক্ষণ হলো, সুস্থ গরুর চামড়ার ওপর দিয়ে কয়েকটা পাঁজরের হাড় চোখে পড়বে। সুস্থ গরু বাঁধা অবস্থায় প্রায়ই যেনতেনভাবে ছুটতে চাইবে, ঘন ঘন লেজ নাড়বে, হাঁকডাকে জোরালো হবে। এছাড়া দুরন্তপনার মধ্যেও পরক্ষণেই আবার সামনে রাখা খাদ্যে মুখ ডোবাবে। সুস্থ গরু চেনার আরেকটি অন্যতম উপায় হচ্ছে মুখে জাবর কাটবে। অসুস্থ গরুর শরীরে তাপমাত্রা বেশি থাকবে এবং পাতলা পায়খানা হবে। মুখ দিয়ে লালা ঝরবে। সামনে খাবার থাকলেও খাবে না, এমনকি জাবরও কাটবে না।

তাছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে ও কোরবানির পশুর চামড়ার মান বজায় রাখতে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গবাদিপশু কোরবানির জন্য এবং চামড়া ছাড়ানো ও সংরক্ষণ বিষয়ে ইতোমধ্যে ১৫ হাজার ১৩২ জন পেশাদার কসাই এবং ১৬ হাজার ৬৬৭ জন মৌসুমি কসাইসহ সর্বমোট ৩১ হাজার ৭৯৯ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহা-২০২৩ উদযাপন উপলক্ষে সড়কের উপরে যত্রতত্র কোরবানির পশু জবাই না করে যথাসম্ভব নির্ধারিত স্থানে কোরবানি করার নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি অফাল (নাড়ি ভুড়িসহ অন্যান্য বর্জ্য) যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করার জন্য সিটি কর্পোরেশনসহ জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ কর্তৃক ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

তাছাড়াও ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্য আর্থিক দুর্ঘটনা এড়াতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পশুর হাটগুলোতে ক্যাশলেস লেনদেন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেমন জাল টাকার বিস্তার, চুরি-ছিনতাই ইত্যাদি হ্রাস পাবে।

সর্বোপরি কোরবানি উপলক্ষে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের ভেজালমুক্ত কোরবানির পশু ও বিড়ম্বনাহীন পশুর হাট উপহার দেয়ার এ উদ্যোগ সফল হউক।

লেখক: কৃষিবিদ মো. সামছুল আলম, গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, তথ্য দফতর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
মোবাইল: ০১৭৪৬ ৭৪৯০২০, [email protected]

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর