ইসলামি অর্থনীতিতে জাকাতব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য রক্ষা করে সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। ‘জাকাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র, আত্মা শুদ্ধ হয় এবং জাকাত প্রদানে সম্পদে বরকত হয়। ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত—এই বলে সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই, আর নিশ্চয় হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, সালাত কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, হজ করা ও রমজান মাসে সিয়াম পালন করা। (বুখারি: ৭)। জাকাত নিছক একটি দান নয়, বরং এটি একটি ফরজ ইবাদত। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে, গরিব-দুস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে জাকাত বলা হয়। কোরআন ও হাদিসে জাকাতের গুরুত্ব বারবার তুলে ধরা হয়েছে এবং মুসলিম অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের একটি কার্যকর হাতিয়ার। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তাদের ধন সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক ‘ (সুরা আয-জারিয়াত : ১৯) । এর মাধ্যমে আল্লাহ ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধনীদের থেকে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হয়, ফলে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হয়।
মুসলিম ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে সেদিন থেকে এক চান্দ্রবর্ষ (৩৫৪-৩৫৫ দিন) পূর্ণ হলে তাকে জাকাত প্রদান করতে হয়। জাকাতের নিসাব হলো, সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর কোনো একটির সমমূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার পণ্য। নিসাব পরিমাণ ও তদূর্ধ্ব সম্পদের মালিক তার জাকাতযোগ্য সব সম্পদের জাকাত প্রতি বছর ২.৫% (চল্লিশ ভাগের এক ভাগ) হারে প্রদান করতে হয়। জমি, বাড়ি ও গাড়ি যা বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়নি, তা জাকাত হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি যেগুলো বিক্রয়ের জন্য রাখা হয়েছে, সেগুলোর বর্তমান বিক্রয়মূল্য (বাজারদর) জাকাতের হিসাবে আসবে এবং এর মূল্য হিসাব করে প্রতি বছর জাকাত দিতে হবে। জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ যাবে তাৎক্ষণিক পরিশোধযোগ্য ঋণ এবং কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ঋণের চলমান কিস্তির পরিমাণ অর্থ বাদ রেখে অবশিষ্ট সম্পদের জাকাত দিতে হবে। যেসব ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন দেখা যায়, তাদের সম্পদ অপেক্ষা ঋণের পরিমাণ বেশি। এ অবস্থায়ও তাদের ঋণ ধর্তব্য হবে না; বরং তাদের এসব খাতের সমুদয় সম্পদেরই জাকাত প্রদান করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
আল্লাহ তায়ালা জাকাতের অর্থ যাদের দেওয়া যাবে তা পবিত্র কোরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন ফকির, মিসকিন, জাকাত উসুল ও আদায়ের কাজে নিয়োজিত, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, জেহাদকারীর জন্য এবং মুসাফিরকে জাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে।
জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। জাকাত আদায়ের সময় ‘জাকাতের টাকা’ উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। আদায়ের সময় বা জাকাতের টাকা আলাদা করার সময় নিয়ত করলেই হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, জাকাতের ক্ষেত্রে গরিবকে মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত। কাজেই জাকাতের টাকা দিয়ে মসজিদ বানানো, মাদরাসা বানানো, রাস্তাঘাট নির্মাণ, কূপ খনন ইত্যাদি করা যাবে না। বরং সরাসরি গরিবকে জাকাতের টাকার মালিক বানিয়ে দিতে হবে।
কোনো গরিবকে পড়াশোনা, চিকিৎসা, বিবাহ দেওয়ার জন্যও জাকাত দেওয়া যেতে পারে। তবে তাকে সে টাকার মালিক বানিয়ে দিতে হবে। জাকাতের কারণে দারিদ্র্য কমে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হয়। মুসলিম অর্থনীতিবিদ ইবনে খালদুন তার ‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, জাকাত একটি কার্যকর সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যবস্থা, যা অর্থনীতিতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মুআয (রা.)-কে ইয়ামান দেশে (শাসক হিসাবে) পাঠান। অতঃপর বললেন, সেখানকার অধিবাসীদের তুমি এ সাক্ষ্যদানের প্রতি আহ্বান করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল। যদি তারা তা মেনে নেয়, তবে তাদের অবগত কর যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর প্রতিদিনে ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। যদি সেটাও তারা মেনে নেয়, তবে তাদের অবগত কর যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর সম্পদের মধ্য থেকে সদকা (জাকাত) ফরজ করেছেন। যেটা ধনীদের কাছ থেকে গৃহীত হবে আর দরিদ্রদের মধ্যে দেওয়া হবে। এভাবে স্পষ্টভাবে নবী (সা.) সাহাবিদেরকে জাকাত প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দেশনা দিতেন। জাকাত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়। আধুনিক অর্থনীতিবিদরাও মনে করেন, জাকাতের সঠিক বাস্তবায়ন হলে সমাজে বেকারত্ব কমবে এবং নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত হবে।
বিজ্ঞাপন
অপর দিকে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ ধনীদের আরও ধনী করে এবং গরিবদের আরও বঞ্চিত করে। কিন্তু ইসলামিক অর্থনীতিতে জাকাত ধনীদের থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে, অর্থনীতিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিত হয়। ইসলামি অর্থনীতিতে জাকাতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র এমন একটি কাঠামো তৈরি করবে যার মাধ্যমে জাকাত প্রদানের উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গ নির্দিষ্ট সময় শেষে জাকাত ফান্ডে অর্থ জমা করবেন। এ জমাকৃত অর্থ কোরআনে বর্ণিত আট শ্রেণির লোকদের নিকট উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকল্পনা নিয়ে বিতরণ করতে হবে। উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গকে অবশ্যই জাকাত প্রদান করতে হবে। এ সম্পর্কে হজরত আবু বকর (রা.) বলেন- আল্লাহর শপথ! তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই আমি যুদ্ধ করব, যারা সালাত ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, কেননা জাকাত হলো সম্পদের ওপর আরোপিত হক। আল্লাহর কসম। যদি তারা একটি মেষশাবক জাকাত দিতেও অস্বীকৃতি জানায়, যা রাসুল (সা.)-এর কাছে তারা দিত, তাহলে জাকাত না দেওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করব। সুতরাং জাকাত শুধু দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার নয়, বরং এটি সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে শক্তিশালী করে। তাই বলা যায়, জাকাত একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যা দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও বৈষম্য দূর করে একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব দূর করতে জাকাত ভূমিকা করে থাকে। জাকাতের অর্থ দিয়ে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়। জাকাতের অর্থ গ্রহণের পর উপযুক্ত ব্যক্তির মধ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে নানা ধরনের মিল, কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। অথবা বেকাররা স্বাবলম্বী হতে পারে—এ পরিমাণ জাকাতের অর্থ প্রদানেরও সুযোগ রয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্রে জাকাত তোলার জন্য আলাদা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বেকার যুবক ও নারীদের কাজে নিয়োজিত করে তাদের সাবলম্বী করা যেতে পারে । জাকাত সম্পদের বৃদ্ধি করে। জাকাত প্রদানের কারণে সম্পদ কোথাও জমা হয়ে থাকতে পারে না। অগণিত মানুষের হাতে পৌঁছে যায় জাকাতের অর্থ-সম্পদ। তারা তাদের চাহিদা পূরণে তা ব্যবহার করতে পারে এবং তারা প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদকে বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারে। বিনিয়োগের কারণে সম্পদ এক জায়গায় পুঞ্জীভূত হয়ে থাকে না, বরং এর মাধ্যমে সম্পদ বাড়ে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এতে বাজারে চাহিদা বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে। আর উৎপাদন বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ে। ফলে সমাজ থেকে বেকারত্ব ও অভাব দূর হয়। এভাবে জাকাত ইসলামি সমাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে।
আমাদের সমাজের প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি ও বৈষম্য বিরাজমান। এসব বৈষম্যের মূলোৎপাটন করতে হলে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও তার সঠিক প্রয়োগই পারে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সুষম ও ভারসাম্য পূর্ণ দারিদ্র্য মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করতে।
লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক