দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিয়ে বিজয়ের মাসে ‘মেট্রোযুগে’ প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। নদীর মতো সড়কের বুক চিড়ে গড়ে ওঠা মেট্রোরেলের নির্মাণশৈলী এখন নজর কাড়ে যে কারোরই। শুরুতে ধুলা আর খোঁড়াখুঁড়িতে সাময়িক ভোগান্তি হলেও ‘কাটাছেঁড়া’ করা সড়কে পড়েছে পিচের প্রলেপ। সেই সঙ্গে সড়কের মাঝে বসেছে আইল্যান্ড, আবার কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে স্টিলের ব্যারিয়ার। যেগুলোর মাঝখানে ঠাঁই পেয়েছে ‘সবুজায়ন’। বাহারি ফুলসহ ছোট-বড় নানা গাছগাছালিতে তাই নগরীর সৌন্দর্য বেড়েছে বহুগুণ।
নগরজীবনে মেট্রোরেলের এই যাত্রা যেমন গতি নিয়ে আসবে, তেমনি কনক্রিটের স্থাপনা ঘিরে পরিকল্পিত সবুজায়ন ছিল সময়ের দাবি। খোদ মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষও এই কথা বলছে। বৃহৎ এই প্রকল্প নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে- নির্মাণে আধুনিকায়নের পাশাপাশি সবুজায়নেও দৃষ্টি দিতে চান তারা। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই পুরো প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এর জন্য নাগরিকদের সহযোগিতাও কামনা করেছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়- উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা মেট্রোরেল এমআরটি-৬ লাইনের শেষ সময়ের কাজ দ্রুতগতিতেই এগোচ্ছে। উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটারজুড়ে হওয়া এই প্রকল্পের দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও অংশের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের উদ্বোধনকে ঘিরে তাই শেষ সময়ের প্রস্তুতিও চলছে জোরেশোরে। মোট ১৭ স্টেশনের মধ্যে প্রথম দফায় ৯ স্টেশনে চলবে মেট্রোরেল। তাই শেষ সময়ে স্টেশনগুলোর সাজসজ্জার কাজ চলছে। যেখানে যাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার ছাড়াও রেস্টুরেন্ট, বিপণিবিতান, কফিশপ ও বিনোদন কেন্দ্র থাকবে।
এদিকে, কাটাছেঁড়া করা নিচের সড়কেও পড়েছে পিচের প্রলেপ। সেই সঙ্গে কমেছে ধুলা, বেড়েছে সৌন্দর্যও। পুরো এমআরটি-৬ লাইনজুড়ে সড়কের মাঝে আইল্যান্ড তৈরি করা ছাড়াও বসানো হচ্ছে স্টিলের ব্যারিয়ার। এমনকি এরই মধ্যে কয়েকটি স্থানে এসব বসানো শেষে চলছে মাটি ফেলার কাজ। আবার যেখানে এই দুই প্রক্রিয়া শেষ সেখানে গাছের জন্য তৈরি হচ্ছে বীজতলা।
শেরেবাংলা নগরের আগারগাঁও অংশের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনের অংশ ঘুরে দেখা যায়- ইতোমধ্যেই এই অংশে সবুজায়নের ছোঁয়া লেগেছে। সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে রোপণ করা হয়েছে নানা রঙের ফুল ছাড়াও ছোট-বড় নানা গাছ। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝেও তৃপ্তির ঝলক দেখা গেছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে স্থানীয় দোকানি জসিম হাওলাদার ঢাকা মেইলকে বলেন, দীর্ঘদিন পর আমাদের নিশ্বাস ফেলার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতদিন ব্যবসায় যে মন্দা ভাব ছিল, তা ঘুচিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। ধুলা আর খোঁড়াখুঁড়ির কবলে থাকা সড়কেও এখন গতি বেড়েছে। এখন অপেক্ষা রেলে ছড়ার।
বিজ্ঞাপন
সড়কের শোভাবর্ধনের বিষয়ে এই দোকানি বলেন, সময়ক্ষেপণ হলেও মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রতিটি কাজই দৃষ্টিনন্দন। কিছুদিন আগে সড়কের ওপর ঠিক যতটা ধুলার রাজত্ব ছিল, এখন ততটাই পরিষ্কার। সড়কের মাঝে আইল্যান্ড তৈরি করা, স্টিলের ব্যারিয়ারে লাগানো বাহারি গাছগুলোও সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
আরেফিন নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের প্রায় প্রতিটি উদ্যোগই থাকে জনবান্ধব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদাসীনতা কিংবা কর্তৃপক্ষের স্বদিচ্ছার অভাবে এর সুফল হারাতে বসে। মেট্রোরেল ঘিরে সবুজায়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবিদার। তবে উদ্বোধনের পরও যদি এর যথাযথ পরিচর্যা না করা হয়, তবে সৌন্দর্য কিন্তু ঝঞ্ঝাটে রূপ নেবে।
একই কথা বলছে সচেতন মহল। তাদের ভাষ্য- অনেকের মাঝেই ব্যারিয়ারে দোকান কিংবা বাসা-বাড়ির ময়লা ফেলার প্রবণতা রয়েছে। এরমধ্যে ইতোমধ্যেই পিলারে পোস্টার লাগাতে গিয়ে অনেকেই নষ্ট করছেন ফুল গাছ। এছাড়াও নির্ধারিত স্থান দিয়ে পারাপার না হয়ে অনেকেই সড়কের মাঝে থাকা স্টিলের ব্যারিয়ারের ওপর দিয়েই রাস্তা পারাপারের চেষ্টাও করছেন। এতে নষ্ট হচ্ছে সবুজায়ন। কাজেই উদ্বোধনের পরও দৃষ্টিনন্দন এই উদ্যোগের সঠিক পরিচর্যাও প্রয়োজন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। এ জন্য থাকবে পুলিশের আলাদা একটি ইউনিট। যাতে থাকবেন ৩৫৭ জন পুলিশ সদস্য। তারা যাত্রীসহ পুরো মেট্রোরেলের সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করবেন। যদিও বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে হাজারের বেশি সদস্য চেয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। তবে সেই প্রস্তাব কাটছাঁট করে ৩৫৭ জনের বিষয়টি চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ওঅ্যান্ডএম) ফারুক আহমেদ বলেছেন, আমরা হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই হয়ে তা ৩৫৭ করা হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবে ১ হাজার ৩৯ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এ ইউনিটের সদস্যদের জন্য থাকবে আলাদা ইউনিফর্ম। তবে ইউনিফর্ম এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক বলেন, সৌন্দর্য বর্ধনে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা হাতে নিয়েছি। দুই সড়কের মাঝে আইল্যান্ড তৈরি করা স্টিলের ব্যারিয়ার দেওয়া হচ্ছে। যেখানে কেউ সহজেই প্রবেশ করতে পারবে না। এছাড়া মেট্রোরেল পরিচালনায় আলাদা পুলিশ বাহিনী গঠন হলে এমন সব ঘটনাই কমে আসবে।
উল্লেখ্য, আগামী ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘটা করে মেট্রোরেলের উদ্বোধন করলেও সাধারণ যাত্রীরা এতে চলাচলের সুযোগ পাবেন উদ্বোধনের পরদিন (২৯ ডিসেম্বর) থেকে। ‘বাঁচবে সময় বাঁচবে তেল, জ্যাম কমাবে মেট্রোরেল’ এই বিশেষ উদ্যোগের সফল যাত্রায় উদ্বোধনী দিনে টিকেট কেটে প্রথম যাত্রী হিসেবে মেট্রোরেলে চড়বেন সরকারপ্রধান। এছাড়া উদ্বোধনকে ঘিরে ২৮ ডিসেম্বর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দুই হাজার অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
ডিএইচডি/আইএইচ