সুনামগঞ্জের এবারের বন্যা এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালেও যে স্থানগুলোতে পানি উঠেনি তাতেও হাঁটু এবং গলা সমান পানি। বলতে গেলে গত ২০০ বছরের ইতিহাসে এমন বন্যা দেখেনি জেলাবাসী। গুরুজনদের কাছ থেকে শুনতাম, ১৯৮৮ সালের বন্যায় গরুর সাথে মানুষের লাশ সারি সারিভাবে নদীর স্রোতে ভাসছিল। খাবারের জন্য হাহাকার ছিল, কিন্তু খাবার তো দূরের কথা বিশুদ্ধ পানিও মিলেনি। তখন তা স্বাভাবিক ছিল। কারণ আমাদের এত উন্নয়ন ছিল না। ছিল না আমাদের এত সামর্থ্য।
আর ২০০৪ সালের বন্যা পরিস্থিতির তো নিজে সাক্ষী। তখন দেখেছিলাম কীভাবে সাহায্যের হাত একে অপরের প্রতি বাড়িয়েছিল, তা স্বস্তিমূলক ছিল। কিন্তু সেসব সাহায্যকারী হাতের কি এখন মৃত্যু হয়ে গেছে। রেখে যায়নি কি তারা তাদের কোনো উত্তরসূরি।
বিজ্ঞাপন
হায়! এত আধুনিক যুগের হয়েও আমরা পৈশাচিক আর বর্বরতা লালন এবং পালন করি কী করে! আমাদের পূর্বসূরিরা কি অভিশাপ দিচ্ছেন না আমাদের! আসলে ২০২২ এর বন্যা আমাদের কী বার্তা দিয়ে যাচ্ছে!
নিরাপদ আশ্রয়স্থলে আসার পথে পানির ঘূর্ণিতে নৌকা ডুবে এক মায়ের হাত থেকে ৮-১০ বছরের সন্তান কীভাবে তলিয়ে যায় তা এখনও চোখে ভাসে। বুকের মানিক হাত থেকে ফসকে যাওয়ায় চোখে মুখে কী পরিমাণ অসহায়ত্ব নিয়ে সন্তানকে খুঁজছিল তা আর বলার ভাষা রাখে না। হাশর দেখিনি, কিন্তু মনে হয়েছিল এই মায়ের বুঝি মৃত্যু যন্ত্রণা হচ্ছে কিংবা হাশরের মাঠে তোলা হচ্ছে।
আহ্! তখন দেখেছি, সন্তান কীভাবে তার বৃদ্ধ মাকে ঘূর্ণি থেকে রক্ষা করতে জীবনের চিন্তা না করে চিৎকার দিয়ে উদ্ধার করতে। যদিও পরে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারে সক্ষম হয়েছি, তবে ওই মায়ের সন্তানকে আর পাওয়া যায়নি। অথচ এই পরিবারের টাকার কোনো অভাব ছিল না।
নদীর স্রোতে রশি লাগানো মৃত গরু ছাগল ভেসে যেতে দেখেছি। ২-৩ জন জানালেন লাখ টাকার গরুর মায়া ছাড়তে না পেরে নিষেধ না শুনে স্রোতে গরুর সাথে ঝাঁপ দিয়েছে তাদের এক আত্মীয়। ফলাফল স্রোতের সাথে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ।
বিজ্ঞাপন
আরেকজন জানালেন, মাছ শিকারে গিয়ে শুনছেন পার্শ্ববর্তী হাওরে হাতে রশি বাঁধা অবস্থায় গরুর সাথে দুজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। জানি না তা কতটুকু সত্যি। তবে যারা এই বন্যার ভয়াবহতা দেখেছে তারা বলবে মিথ্যা হওয়ার কিছু না। কারণ তাৎক্ষণিক তাদের জানানো সম্ভব হয়নি বা কেউ না জানার কারণ হলো নেটওয়ার্ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
দেখেছি, খাবার আর বিশুদ্ধ পানির জন্য মানুষের হাহাকার। তবুও মন গলেনি ব্যবসায়ী নামক কতিপয় নরপিশাচের। নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, এদের চিনে রাখছে অনেকে। কখনও যদি বিপদে পড়ে তাহলে জবাবটা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে হয়তো। কারণ মানুষ তো জবাব দেওয়ার ওস্তাদ, তারা পাল্টা জবাব দেওয়ার বেলা একটু বেশি সুযোগ সন্ধানী। যদি দুনিয়াতে না পারে হাশরের মাঠে হলেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে এটা ভুল হবে না।
আমার বাড়ির পাশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রের টিউবওয়েল পানির নিচে থাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহের জন্য নিজের ব্যক্তিগত টিউবওয়েল উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আমাদের ২য় তলায় যে ৭-৮টি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলাম তাদের মধ্যে খুব অসহায় ৮-১০ জনের খাবারের দায়িত্ব নিয়েছি। বলেছি চিন্তা করবেন না, আমরা যা খাবো আপনারা তা খাবেন।
দেখেছি, সংকটের বাহানা দেখিয়ে ২০ টাকার মোমবাতির বক্স ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি করতে। অথচ দোকানের পেছন ভর্তি রয়েছে। চিড়ার কেজি ১৫০ টাকা করে এবং ১৫ টাকা দামের পাউরুটি ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি করতেও তাদের বিবেকে ধরেনি।
যাদের আশ্রয়কেন্দ্র আর ত্রাণের খাবার ছাড়া খাওয়া অনিশ্চিত তাদের এসব দামের আগুনে দোকানগুলোর সামনে কান্না করতে দেখেছি। তাদের কান্না দেখে মেঘ গলে বৃষ্টি পড়ে একাকার হলেও এসব পিশাচের মনে মানবতার চিহ্ন দেখা যায়নি।
১৩০০ টাকার গ্যাস সিলিন্ডার ১৮০০-২৫০০-৩০০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখেছি। দাম কমানোর কথা বললে সরল ভঙ্গির মুখ করে ‘শেষ হয়ে গেছে’ বলার মধ্যে পৈশাচিক আনন্দ দেখেছি। বলি, তাদের কি বাচ্চা নেই, নেই কি তাদের বৃদ্ধ মা কিংবা বাবা? তাদের সন্তানের খাবার কিনে নিতে কি আরেক অসহায় এই পিতার টাকা ব্যবহার হবে না! এই পিতাকেও হয়তো তার ছোট্ট সন্তান বলেছিল, আব্বু! রাত থেকে কিছু খাইনি, পানির জন্য চুলায় আগুন নেই। বাজার থেকে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আসার সময় আমার জন্য কিছু নিয়ে আসবে। আচ্ছা, এই পিতা যখন শূন্য হাতে গিয়ে সন্তানের কাছে নিজেকে অযোগ্য পিতা ভাববে আর সেই ব্যবসায়ী পিতা পূর্ণ হাতে গিয়ে যোগ্য পিতা ভাববে তা কি আল্লাহ্ দেখবেন না?
কতিপয় দোকান মালিকের আচরণে প্রতিবাদ করতে গেলেই দোকান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিতেও শুনেছি। কারণ তাদের কাছে গ্রামগঞ্জের সহজ সরল গরিব মানুষ জিম্মি। আর হ্যাঁ, মানুষের দুর্যোগ, দুর্ভোগ, দূর্ভিক্ষে তো পশুদের আনন্দ পাওয়ারই কথা।
দেখেছি, যাদের বৈঠা নৌকা আছে তাদের স্বার্থপরতার চিত্র। এই গ্রামেরই সে এবং সে যেখানে যাবে সাহায্য চাওয়া ব্যক্তিও সেখানে যাবেন। খালি চলে যাচ্ছে, তবু টাকা ছাড়া মানুষ নিলে যেন পাপ হবে!
দেখেছি, মা-বাবা কীভাবে বুক সমান পানির উপর দিয়ে যাওয়ার সময় সন্তানকে মাথার উপর করে নিচ্ছে আর আল্লাহ্কে স্মরণ করছে।
মহাসড়কে হাঁস, গরু, ছাগলের বাসস্থান দেখে কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছে কোনো খামার হয় তো। পাশেই সারিবদ্ধভাবে গাড়ি পার্ক করা দেখে পরক্ষণে মনের কল্পনা ভাঙলো।
সড়কের আরেক পাশে পলিথিন টানিয়ে খড়ের উপর মানুষকে থাকতে দেখে মনে হয়েছে এই বুঝি পৃথিবী জন্ম নিয়েছে এজন্য টিন, ইট কিছুই নেই। যখন দেখলাম পাশের মার্কেটগুলোতে মানুষের জায়গা হচ্ছে না তখনই ভাবলাম এত দুর্যোগ।
একটা ছেঁড়া ছাতা মাথায় দিয়ে মধ্য বয়সি পুরুষকে সড়কের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখেছি। ভাবলাম, হয়তো কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। জিজ্ঞাসা করার পর যখন জানলাম সামনের দ্বিতীয় তলায় উনার পরিবারসহ আরও পরিবার রয়েছে, কিন্তু যৌথভাবে থাকার কারণে তার আর থাকার জায়গা নেই। তাই তিনি নিচ থেকে পরিবারকে দেখে শান্তি পাচ্ছেন। তাতে মনে হলো আহ্, পুরুষের পারিবারিক দায়বদ্ধতা কি এতই কঠিন।
বিদ্যুৎহীন, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, নেটওয়ার্ক নাই। এ যেন ভুতুড়ে পরিস্থিতি। এ যেন যুদ্ধক্ষেত্র। হ্যাঁ, তাই। তবে প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে প্রকৃতির পক্ষে অবস্থান ছিল মানুষরূপী কিছু ব্যবসায়ীর।
পড়েছি, ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তোমরা ওজনে কম দিও না। এবং এটাও পড়েছি, আল্লাহ্ জুলুমের জন্য একদল ব্যবসায়ীর উপর আজাব আর গজব দিয়ে ধ্বংস করেছেন।
আচ্ছা, তাহলে কি এদের পূর্বপুরুষ সেসব ধ্বংস হওয়া গোষ্ঠী ছিল! জানতে বড় ইচ্ছা হয়। নাকি আল্লাহ্ তায়ালা বর্তমানের এসকল ব্যবসায়ীর উদ্দেশে এসব বলেছেন!
একবারও কি ওরা ভাবেনি, জুলুম করে দুই দিনে না হয় ১, ২, ৩ লাখ বা ৫ লাখ টাকা লাভ হবে। কিন্তু আল্লাহ্ যে সর্বশক্তিমান তারা কি তা জানে না! একবার স্ট্রোক করলে বা দোকানে আগুন লেগে গেলে কি আর তখন এই জুলুমের টাকা থাকবে! ধিক্কার এসব নমরুদ, দাজ্জাল আর হাবিল কাবিলের বংশধরকে। এদের ওপর আল্লাহর গজব অনিবার্য। তাদেরও পরিবার সন্তান আছে। আল্লাহ্ সাক্ষী এসব জুলুমের।
লেখক: সাংবাদিক, সুনামগঞ্জ