চারদিকে পানি আর পানি। সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি, সীমান্তের ওপার থেকে আসছে ঢলও। তাই সময় যত গড়াচ্ছে পানি ততই বাড়ছে। সকালে যেসব এলাকা শুকনো ছিল, বিকেলে সেসব এলাকায় হাঁটু পানি। ইতোমধ্যেই সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ ও সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বাকি তিন জেলার শহরের কিছু উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। ঘর-বাড়ি কিংবা বাসা তলিয়ে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এদিক-ওদিক ছুটছেন বানবাসী মানুষ। বিদ্যুৎ ও মোবাইলের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না অনেকে। গবাদি পশু ও ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং উদ্ধার তৎপরতায় সহায়তার জন্য সিলেট-সুনামগঞ্জে নামানো হয়েছে সেনা ও নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিমান বাহিনী ও কোস্টগার্ড।
এদিকে আগামী দুই দিনে এই পানি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
বিজ্ঞাপন
সিলেটের দরগামহল্লা এলাকার বাসিন্দা অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, আমি এই এলাকায় ১৮ বছর থেকে। কখনো পানি হয় নাই। আশপাশের লোকদের সঙ্গেও কথা বলে জেনেছি বিগত দিনেও কখনো পানিতে ডুবে নাই এই এলাকা। অথচ এবারের বন্যায় দরগামহল্লা তলিয়ে গেছে। আমাদের বাসার নিচতলা ডুবে গেছে পানিতে। বের হতে পারছি না।

সিলেট নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী সীমা মল্লিক বলেন, আমাদের কলেজের হোস্টেল এলাকা গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত শুকনো ছিল। আজ জলাবদ্ধ হয়ে গেছে। জানি না এখন কী হবে।
বিজ্ঞাপন
সিলেটের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের বাসিন্দা সাংবাদিক শাহ শরীফ উদ্দিন বলেন, সকাল (রোববার) পর্যন্ত জিন্দাবাজারসহ আশপাশের এলাকায় কোনো পানি ছিলনা। এখন সেখানে হাটু পানি। দ্রুতই বাড়ছে পানি। বন্দরবাজারসহ আশপাশের অনেক এলাকা তলিয়ে গেছে।
অপেক্ষাকৃত সিলেটের সবচেয়ে উচু এলাকা শিবগঞ্জ। এখন সেখানেও হাঁটু পানি। শিবগঞ্জে বাসিন্দা উত্তরা ব্যাংকের কর্মকর্তা এম হারিছ আলী বলেন, ইতিহাসে কোনোদিন এই এলাকা ডুবে নাই। সকাল ১০ টা পর্যন্ত যেসব এলাকা শুকনো ছিল এখন সেখানে হাটু পানি। আরো ৫ ইঞ্চি পানি বাড়লে আমার বাসার নিচতলা তলিয়ে যাবে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিল। কিন্তু এর পর বেশির ভাগ বন্যা মূলত হাওর ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দুই তিন দিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা হয়নি।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয়নি। সিলেটে এর আগে যত বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওর এলাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে। আর সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ, উজানে আগামী দুই দিন অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা ইসিএমডব্লিইউর পূর্বাভাস অনুযায়ী, আজ বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হচ্ছে। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে; যা ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই অল্প কয়েক দিনে এত বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১০০ বছরে নেই।
বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, গোয়াইনসহ বেশির ভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। নদ-নদীর বুক উঁচু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানির ঢল ধরে রাখতে পারছে না। ফলে পানি উপচে দ্রুত বসতি ও শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। হাওর এলাকায় কৃষিকাজসহ নানা তৎপরতার কারণে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। যে কারণে বন্যার পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে।
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সিলেটের পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলেন, ‘পানি দ্রুত বাড়ছে। সিলেটের প্রধান প্রধান সব নদীর পানিই বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঢল না থামলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।’
এসএএস/ একেবি





























































































































































































