উজানের ঢল আর অব্যাহত বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেটে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলায় এক থেকে দুই হাত পর্যন্ত পানি কমেছে। এতে কিছুটা আশার আলো দেখছেন বানভাসি মানুষেরা।
তবে পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি বন্যার্ত মানুষের। প্রায় ৮০ তলিয়ে যাওয়া এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে। নতুন করে আর অবনতি না ঘটলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
শনিবার (১৮ জুন) রাত থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যার পানি কমতে থাকে। স্থানীয়রা জানান, নগরীসহ কিছু কিছু জায়গায় পানি এক থেকে দেড় হাত কমেছে। এতে অনেকে বাসাবাড়িতে ফিরেছেন। এক দিন বন্ধ থাকার পর সিলেটের সঙ্গে রেল যোগাযোগও স্বাভাবিক হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী জানান, রোববার (১৯ জুন) সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খুব কম পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা রেকর্ড করা হয়নি। সোমবার থেকে
আকাশে মেঘের পরিমাণ আরও কমে আসবে। বৃষ্টিপাতও তুলনামূলক কমে যাবে। এতে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে জানান তিনি।
এদিকে দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আস্তে আস্তে উন্নতি হবে। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
বিজ্ঞাপন
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সূত্র মতে, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের স্থানসমূহে মাঝারি থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সব প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনিস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, আগামীকালের পর থেকে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে পারে। তবে, বর্তমানে বিপদসীমা অতিক্রম করে রেকর্ড লেভেলে রয়েছে। এজন্য পানি সম্পূর্ণ নামতে এক সপ্তাহ লাগতে পারে। বন্যার পানি বৃদ্ধি আগামীকালের পরে হ্রাস পেতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে।
গত শুক্রবার ভারতের মেঘালয়ের পূর্ব খাসি হিলস এলাকার চেরাপুঞ্জিতে এক দিনেই ৯০৮.৪ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ১৯৯৮ সালের পর জুন মাসের কোনো দিনে চেরাপুঞ্জিতে কখনও এত বৃষ্টি হয়নি। উজানে এই নজিরবিহীন অতিবৃষ্টি আর ব্রহ্মপুত্র, বরাকসহ বিভিন্ন নদীর বিপুল জলস্ফীতিই ভাটির দেশ বাংলাদেশে বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে।
এদিকে সিলেটে পানি কমে এলেও বানভাসি মানুষের মধ্যে হাহাকার কমেনি। পানিবন্দি লাখো মানুষের নেই খাবারের সংস্থান। বাড়িঘরে পানি উঠে যাওয়ায় গবাদি পশু নিয়েও তারা পড়েছেন বিপদে। পয়ঃনিষ্কাষন ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এক মাসের ব্যবধানে দুই দফায় বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেটের মানুষের খোঁজ নিয়ে আগামী মঙ্গলবার (২১ জুন) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটে যাচ্ছেন। এদিন তিনি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও চালাবেন। এছাড়া বানভাসি মানুষের সহায়তায় সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন সরকারপ্রধান।
বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে মানবিক সহায়তা হিসেবে বিতরণের লক্ষ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার জন্য ৫০ লাখ টাকা করে আরও এক কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে রোববার (১৯ জুন) এই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে দেশের ১১টি জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় মানবিক সহায়তা হিসেবে জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে ১৭ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ১,৭২০ মেট্রিক টন চাল, দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং ৫৮ হাজার শুকনো ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
রোববার সিলেট সফর করেছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। এ সময় তিনি জানিয়েছেন, বন্যার্তদের জন্য যা যা করার দরকার সবকিছু করতে সেনাবাহিনী প্রস্তুত।
সেনাপ্রধান বলেন, 'বন্যা দুর্গতদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা জনগণ ও সরকারের প্রত্যাশা পূরণে যা যা করা দরকার সব করব।'
সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'সেনা সদস্যদের প্রতি সর্বোচ্চ ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে দুর্গত মানুষকে সহযোগিতা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।'
জেবি