সোমবার বিকেল পাঁচটা। সিএনজিযোগে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপের শেষ মাথার মিস্ত্রিপল্লীতে গিয়ে নামতেই কালো শার্ট পরিহিত এক যুবক ছুটে এসে পরিচয় জানতে চান। সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই কোনো কথা না বাড়িয়ে বললেন, ‘ভাই আমার ঘরটা দেখে যান একটু। টিনের চালা উড়ে গেছে। ঘরের লোকজন নিয়ে ঘুমাতে পারছি না। আবার ঝড়-বৃষ্টি হলে কিছুই টিকবে না।’
কবির হোসেন নামের এই জেলের অনুরোধ শুনে কাছে গিয়ে দেখা যায়, কিছু অংশ টিন আর ঘরের সামনের অংশে পলিথিন। ত্রিপল দিয়ে করা ঘরের উপরের তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুধু করিবদের ঘরই নয়, এখানকার মিস্ত্রিপাড়া, জালিয়াপাড়াসহ আশপাশের বেশকিছু জায়গা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেকেরই ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে।
বিজ্ঞাপন
গত রোববার (১৪ মে) ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র আঘাতে অনেকটাই তছনছ হয়ে গেছে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন, টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপ। ঝড়ের আঘাতে সামান্য হলেও ক্ষতি হয়নি- এমন বাড়িঘর পাওয়া কঠিন। পুরো জেলায় পাকা-কাঁচা মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার ঘর পুরোপুরি, কিংবা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ে সেন্টমার্টিন ছাড়াও টেকনাফ সদর, পৌর এলাকা, সাবরাং, ডেইলপাড়া, জাদিমুড়া, কোনারপাড়া ও গলাচিপা, বাহারছরা, হোয়াইক্যং এবং শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় প্রচুর গাছপালা ছাড়াও ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে ঘরের চাল। তবে বড় বিপত্তি- হঠাৎ দুর্যোগে বড় ক্ষতির মুখে পড়া এসব মানুষের বেশিরভাগেরই আর্থিক সামর্থ্য নেই। কারণ, এখানে ব্যবসায়ী-প্রবাসী ছাড়া অন্য যারা আছেন, তারা কেউ কৃষি, কেউ লবণ চাষের দিনমজুরের কাজ করেন। এছাড়া বেশিরভাগই জেলে।
তাই ক্ষতিগ্রস্ত সবার দাবি- দ্রুতই সঠিকভাবে তালিকা করে যেন সবাইকে সহযোগিতা করা হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক কাটেনি এখনো
বিজ্ঞাপন
শাহপরীর দ্বীপের জেটিতে দাঁড়িয়ে ষাটোর্ধ্ব শুক্কুর আলীর সঙ্গে কথা হয় সোমবার (১৫ মে) বিকেলে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। ওই সময়ের দৃশ্য কেমন ছিল- এমন প্রশ্ন করতেই আতঙ্কমাখা চোখে শুক্কুর আলী বলেন, ‘বলে বোঝানো যাবে না। মনে হয় ভবন নড়ে উঠছে। পিলার ধরে আল্লাহ’রে ডাকছি। বাচ্চা, মহিলারা সবাই কান্নাকাটি করছে। বাতাসের শব্দ মনে হয় কানে বাজতেছে এখনো।’
পাশেই দাঁড়ানো আরেকজন বলেন, ‘মনে হইতেছিল এই বুঝি সব ভেঙে যাচ্ছে। অনেকে জোরে জোরে কান্না করছে। কপাল ভালো ভাটার সময় আর উত্তর দিয়ে বাতাস আসছে। না হলে বহু মানুষ মারা যেত। ওই সময়ের কথা মনে পড়লেই ভয় লাগে।’
ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় অজানা
ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র পর কক্সবাজারের ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাদের ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে তাদের কম হলেও লাখখানেক টাকা লাগবে ঘর মেরামত করতে। আর আংশিক যাদের ভেঙেছে তাদেরও অন্তত ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হবে। কিন্তু হঠাৎ এত টাকা কীভাবে ব্যবস্থা করবেন- সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বেশিরভাগ মানুষ।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন সহযোগিতা না পেয়ে দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের। যদিও প্রধানমন্ত্রী সোমবার (১৫ মে) সংবাদ সম্মেলনে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। সেই সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন বলেও জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে শাহপরীর দ্বীপ এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে শুরু করেছি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সেই তালিকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দফতরে দেওয়া হবে। পরে আশা করি সরকারিভাবে সহযোগিতা আসবে।’
কোন ধরনের সহযোগিতা বেশি দরকার- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যাদের ঘর ভেঙেছে তাদের কষ্ট বেশি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বেশি নজর দিতে হবে। সরকার যদি আংশিক সহযোগিতাও করে তাহলে উপকার হবে। এ ক্ষেত্রে এনজিওগুলো এগিয়ে আসলে কাজটা সহজ হবে।’
আলাপচারিতায় এই জনপ্রতিনিধির পাশে দাঁড়ানো একজন জেলে বলেন, ‘কারও ঘর নেই, বাসায় খাবার আছে। কারও ঘের আছে, কিন্তু খাবার নেই। এখন আমাদের ঘরও মেরামত লাগবে, আবার খাবারও লাগবে। নইলে টেকা যাবে না।’
হঠাৎ বেড়ে গেছে টিন-বাঁশের দাম
শাহপরীর দ্বীপের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের অভিযোগ, ঘর মেরামতে ব্যবহৃত টিন, বাঁশ, পলিথিনের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। ২ হাজার ৮০০ টাকার টিন এখন ৩ হাজার ৫০০ টাকার নিচে বিক্রিই করছেন না দোকানিরা। সেই সঙ্গে বাঁশের দামও বেড়ে গেছে। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই।
স্থানীয় প্রসাধনী ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘হঠাৎ করে টিনের দাম বেড়ে গেছে, বাঁশের দাম বেড়ে গেছে। নিম্নআয়ের মানুষ কীভাবে এত টাকা দিয়ে জিনিসপত্র কিনে ঘর ঠিক করবে? আলুর কেজি ৮০ টাকা, মোমবাতির দাম দ্বিগুণ বেড়েছে।’
শাহপরীর দ্বীপ বাজারের টিন ও গৃহস্থলী পণ্য বিক্রি করেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন একজন ব্যবসায়ী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গাড়িতে করে কক্সবাজার থেকে মালামাল আনতে খরচ বাড়ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরাও হঠাৎ দাম বাড়ানোর জন্য আমাদেরও কিছুটা বাড়াতে হয়েছে। এটা ঠিক হয়ে যাবে।’
বিধ্বস্ত বাড়িঘর রেখে পেটের টানে সাগরে
টেকনাফের জালিয়াপাড়া ঠিক সাগরের পাশে অবস্থিত। উঁচু রাস্তার পাশে এই পল্লীতে ৬শ’র মতো পরিবার আছে। এখানকার মানুষ সাগরে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এখানেও বেশিরভাগ ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু একদিন সাগরে না গেলে যাদের পেট চলে না, তাদের যেন ভাঙা ঘর নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সময় নেই!
সোমবার (১৫ মে) সন্ধ্যায় এখানে কথা হয় ইবরাহীম নামে এক জেলের সঙ্গে। দলবল নিয়ে জাল নিয়ে মাছ ধরতে সাগরে নামার পূর্ব প্রস্তুতি সারছিলেন ঠিক সন্ধ্যার আগে। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘একদিন বসে থাকলে পেট চলে না, এরমধ্যে বিপদ হয়ে গেছে। ভাঙা ঘর মোটামুটি ঠিকঠাক করে আবার মাছ ধরতে যাচ্ছি। দুদিন পর ৬৫ দিনের জন্য সাগরে নামা নিষেধ। তখন কেমনে দিন চলবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’
মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধিতে আগামী শুক্রবার (১৯ মে) মধ্যরাত থেকে আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। তখন কেউ আর সাগরে মাছ ধরতে পারবে না। তবে এই সময়ে জেলেদের জন্য ৮৬ কেজি চাল বরাদ্দ বরাদ্দ হলেও এ নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ। অনেক সময় প্রকৃত জেলে চাল পান না- এমন অভিযোগও আছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কার্ডধারী সবাই চাল পাবেন। এখন এই পল্লীতে প্রায় ৩শ’র মতো নতুন জেলে আছে। ভোটার আইডি কার্ডের ঝামেলার কারণে তাদের কার্ড হয়নি। আমরা চেষ্টা করতেছি কার্ড করার।’
কর্মকর্তারা কী বলছেন?
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান ঢাকা মেইলকে বলেন, জেলেদের জন্য বরাদ্দ হওয়া চালের মধ্যে প্রথম দফায় ৫৬ কেজি চাল ইতোমধ্যেই বরাদ্দ হয়ে গেছে। শিগগিরই পাবেন জেলেরা। পরের ধাপে ৩০ কেজি উল্লেখিত সময়ের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। এই বরাদ্দের বাইরে এই মুহূর্তে জেলেদের জন্য আর কিছু নেই। তবে যাদের ঘর ভেঙেছে তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা দেওয়া হবে।
কার্ড নেই এমন জেলেদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা চলমান প্রক্রিয়া। অনেকে পেশা পরিবর্তন করলে কার্ড বাতিল হয়। কেউ নতুন হলে আবার কার্ড পান। তবে কার্ড না থাকলেও জেলে হিসেবে তালিকাভুক্ত সবাই বরাদ্দ হওয়া চাল পাবেন। এখানে অনিয়মের সুযোগ নেই।’
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সরকারের সহযোগিতার বিষয়ে কথা হলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত তুলে নেওয়ার পর আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকজন বাড়িঘরে ফিরেছেন। যাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে ঘর মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দ্রুতই তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিইউ/কেআর/আইএইচ

















































































































































































































































































