দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় মোখা শক্তি আরও বাড়িয়ে শুক্রবার (১২ মে) সকালে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। ঘুর্ণিঝড়টি আগামী রোববার (১৪ মে) দুপুর নাগাদ ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে।
আবহাওয়ার এমন পূর্বাভাসে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, সীতাকুন্ড, সন্দ্বীপ, মিরসরাই উপকূলসহ সবকটি উপজেলার মানুষের মাঝে এখন চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কায় রয়েছেন উপকূলের মানুষেরা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। যা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে উপকূলবাসী।
বিজ্ঞাপন
আনোয়ারা উপকূলবর্তী জুঁইদন্ডি এলাকার পারভেজ হোসেন বলেন, অতীতের সবকটি ঘূর্ণিঝড়ের সময় জুঁইদন্ডির বিস্তীর্ণ এলাকা উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ডুবে গিয়েছিল। এবারও সেই আতঙ্ক বিরাজ করছে মানুষের মনে। জলোচ্ছ্বাস হলে এলাকার অনেক অপরিপক্ক বোরো ধান নষ্ট হয়ে যাবে। নষ্ট হবে শত শত একরের সবজি ক্ষেত। মারা যাবে গরু-ছাগল। এছাড়া এই উপকূলের অনেক মানুষ মাছ ধরতে গিয়ে এখনো সাগর থেকে ফিরেনি। তাদের ভাগ্য কী হবে এ নিয়ে মানুষ বেশ চিন্তিত।
একই কথা বলেছেন বাঁশখালী উপকূলের গন্ডামারা ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল জব্বার। তিনি বলেন, মোখার প্রভাবে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এলাকার শত শত হেক্টর জমির লবণের মাঠ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। নষ্ট হতে পারে অপরিপক্ক বোরো ধান। তাছাড়া এলাকার কয়েক হাজার জেলে সাগরে মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। তাদের অনেকে এখনো ফিরেনি।
এদিকে সীতাকুন্ড উপকুলের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. ইউসুপ জানান, উপজেলার প্রায় ২৪ কিলোমিটার উপকূলে অনেক চাষাবাদ হয়েছে। রয়েছে সবজি ক্ষেত। যা মোখার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে এলাকার মানুষ।
তবে আশার আলো হচ্ছে, এর আগের সবকটি ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূল ছিল অরক্ষিত। এবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের ফলে অনেকটা সুরক্ষিত। কিন্তু মোখা যদি প্রবল আঘাত হানে ওই বাঁধ তো উপরে যেতে পারে। আর জলোচ্ছ্বাস হলে তো ব্যাপক ফসলহানি ও প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ফসলহানির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আতিক উল্লাহ খান ঢাকা মেইলকে বলেন, চলতি মৌসুমের ৯০ শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে। আগাম জাতের বোরো ফসলের চাষ করায় এবার ধান আগাম পেকেছে। বাকি ১০ শতাংশ ধানও আশা করি আজকালের মধ্যে কাটা হয়ে যাবে। কৃষি অফিসের কর্মীরা এ বিষয়ে মাঠে করছেন। আর ধান এখন অপরিপক্ক থাকার কথা নয়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে প্রস্ততি
প্রাণহানিসহ ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাত ও জানমাল রক্ষায় চট্টগ্রামের উপকূলীয় পাঁচ উপজেলাসহ জেলার ১৫ উপজেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। শুক্রবার (১২ মে) দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান এই তথ্য জানান।
ডিসি বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাত ও জানমাল রক্ষায় চট্টগ্রামের উপকূলীয় পাঁচ উপজেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র ও সাত হাজার স্বেচ্ছাসেবক। দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রাথমিক চাহিদা মিটানোর জন্য ১৫টি উপজেলায় ত্রাণ হিসেবে চাল ও নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রস্তুত রাখার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তারা জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৃহস্পতিবার ঘূর্ণিঝড় মোখার মোকাবিলায় প্রস্তুতিমূলক সভা করেছেন।
বাঁশখালী উপজেলায় ১১০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনও সাইদুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, উপজেলার উপকূলীয় এলাকা ছনুয়া, খানখানাবাদ, গন্ডামারা, সরল, বাহারছড়া, কাথরিয়া, সাধনপুর, পুকুরিয়া, পুইছড়ি, শেখেরখীল ও শীলকুপ এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার এবং মুজিব কিল্লাসহ ১১০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাগরে যে সব জেলে রয়েছেন তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ৭১টি ইউনিটে এক হাজার ৪২০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি এড়াতে উপকূলীয় এলাকার মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এবং পাহাড় ধস এড়াতে পাহাড়ি এলাকার মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। এছাড়া প্রত্যেক মসজিদে জুমার নামাজের বয়ানে ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে বলার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সব ইমামকে বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আনোয়ারা উপজেলার ইউএনও মো. ইশতিয়াক ইমন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোতে এক হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। খোলা থাকবে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র। জেলা প্রশাসন থেকে ৪০ হাজার টাকা ও ১০ মেট্রিক টন খাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সচেতনতার জন্য মাইকিং করে জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে।
সীতাকুন্ড উপজেলার ইউএনও মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুত করা হয়েছে ৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি ভবনগুলোও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে জরুরি সেবা দিতে ১২টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক।
সন্দ্বীপ উপজেলার ইউএনও সম্রাট খীসা বলেন, উপজেলায় ১১২টি সাইক্লোন শেল্টারসহ মাধ্যমিক স্কুল, মাদরাসা ও কলেজসহ মোট ১৬২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া উড়িরচরে তিনটি মুজিব কিল্লা ও মুছাপুর ইউনিয়নে একটি মুজিব কিল্লা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে তিন হাজার ভলান্টিয়ার। সঙ্গে প্রস্তুত রয়েছে যুব রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা। পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা রয়েছে।
অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় কন্ট্রোল রুম খুলেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এখান থেকে জরুরি হটলাইন নম্বরে (০২৩-৩৩৩-৬৩০-৭৩৯) ঘূর্ণিঝড়সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও সেবা পাবেন চট্টগ্রামবাসী। পাশাপাশি জানমালের ক্ষতি কমাতে ৪১টি ওয়ার্ডে ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
চসিক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানলে যেন সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায় এবং দুর্যোগপরবর্তী পুনরুদ্ধার কাজ সর্বোচ্চ গতিতে পরিচালিত হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রস্তুতি সভা ও ঘূর্ণিঝড় মোখার গতিবেগ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জরুরি যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তুতি নিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও
ঘূর্ণিঝড় মোখার ফলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদফতর। একই সঙ্গে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিদ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়।
শুক্রবার (১২ মে) আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ ১১ নম্বর বিশেষ বুলেটিনে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর থেকে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক এ তথ্য জানান।
সচিব বলেন, এর আগে সমুদ্র বন্দরসমূহকে ২নং হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হলেও বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল। তবে চার নম্বর সংকেত দেখাতে বলার পর ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে। বন্দরের স্টান্ডিং কমিটির মিটিং ও অন্যান্য বিষয়ে বিভিন্ন কমিটিকে অ্যালার্ট করা হচ্ছে। সব ধরনের লাইটার জাহাজকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হচ্ছে। ৫নং সংকেত দেখাতে বললে জেটিতে থাকা জাহাজ বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
ঘূর্ণিঝড় মোখার সর্বশেষ খবর
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশের উপকূলের দিকে আরও এগিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১০০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখাসংক্রান্ত আবহাওয়ার একাদশ বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৪ নম্বর স্থানীয় হঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার; যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।
জেবি