বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে আঘাত হানলেও আশঙ্কার চেয়ে অনেকটা কম ক্ষতি হয়েছে উপকূলে। বলা হচ্ছে আঘাত হানার আগেই কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ায় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের মানুষ। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের মুখে তাই সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তবে এর বাইরেও উপকূলে দক্ষিণের বদলে উত্তর দিক থেকে প্রবল বাতাস ও ভাটার টানের সময় মোখা আঘাত হানায় কোনো প্রাণহানি আর বড় ক্ষতির আগেই বিদায় নিয়েছে ঘূর্ণিঝড়। এমনটাই বলছেন টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা।
যদিও ঘূর্ণিঝড়ে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফের প্রায় ২০ হাজার কাঁচা ঘর পুরোপুরি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার গাছ ভেঙেছে। তছনছ হয়ে গেছে পানের বরজ, লবণের ক্ষেতসহ কৃষিপণ্য।
বিজ্ঞাপন
ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন অর্থাৎ সোমবার (১৫ মে) দিনভর এই এলাকার একাধিক বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের। সবার কণ্ঠেই একই কথা শোনা গেছে। যাদের মধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রবীণ মানুষরাও আছেন। যারা ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে সবশেষ সিত্রাং স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা আছে।
এমন কি আবহাওয়া অধিদফতরের পক্ষ থেকে এমনটা বলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা শুক্কুর আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, সব ঘূর্ণিঝড় দ্বীপের দক্ষিণ দিক দিয়ে আঘাত করত। যে কারণে ক্ষতি হতো। এবারও ভাবছিলাম তেমন হবে। কিন্তু আল্লাহর রহমত উত্তর দিক দিয়ে বাতাস আসছে। নইলে লাশ পড়ে থাকত। আর বাড়িঘর থাকত বুড়িগঙ্গায়।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, মোখার প্রভাবে গত রোববার সকাল থেকে সেন্টমার্টিনে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। এ সময় কক্সবাজারে ঝড় দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবল বেগে ধেয়ে আসে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় উল্টো চিত্র। দুপুর থেকে বাতাস উত্তর দিক থেকে বইতে শুরু করে। উত্তরের বাতাস অব্যাহত থাকায় বদলে যায় ঝড়ের গতি। এছাড়াও সাগরের ঢেউয়ের উচ্চতাও কম ছিল। তাই বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পায় পুরো কক্সবাজার।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, উত্তর দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হওয়াতে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার গতিপথ পরিবর্তন হয়। পরে মিয়ানমারের দিকে ধাবিত হওয়াতে কক্সবাজারের টেকনাফ, সেন্টমার্টিনসহ অন্যান্য এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। না হলে ভয়াবহ অবস্থা হতে পারত।
যদিও এবারের ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাস হওয়ার বিষয়টি জোর দিয়ে বলা হচ্ছিল। হয়তো গতিপথ ঠিক থাকলে তেমনটা হতে পারত। যে কারণে কক্সবাজারের বাসিন্দাদের বেশি আতঙ্কে ছিলেন।

তবে শেষ পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হয়নি। অবশ্য এজন্য এখানকার মানুষ ভাটার সময় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানায় এবং উত্তর দিক দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হওয়ায় জলোচ্ছ্বাস বা সমুদ্রের পানি কম হয়েছে বলে মনে করেন।
ষাটোর্ধ্ব শুক্কুর আলী বলেন, যদি জোয়ারের সময় আর দক্ষিণ দিয়ে বাতাস হইলে এখন লাশ গুনতে হতো। আল্লাহ রহমত তো আছেই।
শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা মুজিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, অতীতে যতসব ঘূর্ণিঝড় হয়েছে সেই সব ঝড় দক্ষিণ দিক থেকে এসেছে। তবে এবার উত্তর দিক থেকে ঝড় আসেছে। তাই বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাইছি আমরা।
তিনি বলেন, এইবারে ঘূর্ণিঝড়ে শাহপরীর দ্বীপের যেসব বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সামনের (দক্ষিণ) দিকের চেয়ে পেছনের দিকে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
একই কথা ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন শাহপরীর দ্বীপের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় আসার তিন দিন আগে থেকেই কাজ করছি। আমার ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নিরাপদে রাখার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসি।
কীভাবে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবার দক্ষিণ দিক থেকে ঝড় আসে। এবারও দক্ষিণ দিকে থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু এবার উত্তর দিক থেকে ঝড় আসছে। তাই আমরা বড় ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাইছি।

এই জনপ্রতিনিধি অনেকটা আতঙ্ক নিয়ে বলেন, যদি দক্ষিণ থেকে ঝড় আসত অনেকে মারা যেতে পারত। পানিতে ভাসিয়ে নিতে পারত।
কোন এলাকায় কেমন ক্ষতি করল মোখা
ঘূর্ণিঝড়ে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সদর, পৌর এলাকা, সাবরাং, ডেইলপাড়া, জাদিমুড়া, কোনারপাড়া ও গলাচিপা, বাহারছরা, হোয়াইক্যং, শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় প্রচুর গাছপালা এবং ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। উড়ে গেছে ঘরের চাল। এসব এলাকার মানুষকে সড়ক থেকে গাছ সরাতে দেখা গেছে। অনেকে বাড়িঘর মেরামতে কাজ শুরু করেছেন। অনেককে আবার সাগরে যাওয়ার উদ্দেশে জাল প্রস্তুত করছেন।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হওয়া সেন্টমার্টিনের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিব জানিয়েছেন, প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী সেন্টমার্টিনে প্রায় সাড়ে ৯০০ কাঁচা ঘরবাড়ি ও ৩ শতাধিক টিনের আধাপাকা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে সাতশটি কাঁচা ও ৩৫-৪০টি টিনের ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। পুরো দ্বীপে চার শতাধিক নারকেলগাছ উপড়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক হাজার গাছগাছালি ও কয়েক কিলোমিটার রাস্তা।
জেলার ক্ষয়ক্ষতির কথা বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, জেলার ৫৭টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভা দুর্যোগকবলিত হয়েছে। এসব এলাকার ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬২০ মানুষের ১০ হাজার ৬৬৯ ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। আর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ২২টি ঘর। সবচেয়ে বশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেন্টমার্টিন। এই দ্বীপের প্রায় ১ হাজার ২৫০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
কেআর/বিইউ/এইউ

















































































































































































































































































