আবারও তীব্র তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। আর এর মধ্যে গত কয়েক দিন ধরে চলছে ‘ঘূর্ণিঝড় মোখা’ নিয়ে আলোচনা।
এটা কেমন ঘূর্ণিঝড় হবে? কবে, কোথায় এই ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়বে? ঘণ্টায় এর সর্বোচ্চ গতিবেগ কত হবে? ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা কতটা?- এরকম নানান প্রশ্ন এখন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগর এলাকায় লঘূচাপ সৃষ্টি এবং এটি ঘণীভূত হবার সম্ভাবনার তথ্য দিলেও বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর ঘূর্ণিঝড়ের কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেছেন “লঘুচাপটি মঙ্গলবারের মধ্যে নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে ও ১১ তারিখের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। কিন্তু এখনও বলা যাচ্ছে না। আরও বিভিন্ন বিষয় দেখে আমরা পরে বলতে পারব।”
অন্যদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর ইতোমধ্যেই ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত সতর্কবার্তা দেওয়া শুরু করে দিয়েছে।
ভারতের আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, লঘুচাপটি শক্তি সঞ্চয় করে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে এবং সেটা উত্তর দিক বরাবর অগ্রসর হয়ে মধ্য বঙ্গোপসাগরের দিকে যাবে। এই গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা করছে ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর।
বিজ্ঞাপন
তবে এই ঘূর্ণিঝড়টি কতটা শক্তিশালী হবে বা কতটা শক্তি নিয়ে কোথায় আঘাত হানবে তা নিয়ে এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলছেন না আবহাওয়াবিদরা। মে মাসে তৈরি হওয়া অতীত ঘূর্ণিঝড়গুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সময়ে ঘূর্ণিঝড় বেশ শক্তিশালী হওয়াটাই স্বাভাবিক।
“এটা এখনও অনেক দূরে, দূরের থেকে যে কোনো দিকে টার্ন নিতে পারে। কিন্তু মডেল যেহেতু দেখাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হবে, এদিকে আসার সম্ভাবনাই বেশি,” বলেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড.সমরেন্দ্র কর্মকার।
বাংলাদেশে যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে তার বেশ কিছু ছিল মে মাসে। সেসব ঘূর্ণিঝড়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা আছে।
“এই সময়ে ঘূর্ণিঝড় হলে বাতাসের তীব্র গতিবেগ থাকে, আমাদের নজর রাখতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে” বলে উল্লেখ করেন ড. সমরেন্দ্র কর্মকার।
অন্যদিকে কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলছেন, দু‘টি আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল বিশ্লেষণ করে তিনি দেখেছেন যে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানার সম্ভাবনাই বেশি এবং ভোলা থেকে কক্সবাজার জেলার মধ্যবর্তী স্থান নিয়ে উপকূলে আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে।
কবে আঘাত হানতে পারে?
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লঘুচাপটি নিম্নচাপে রূপ নিয়ে এগুতে থাকলে আস্তে আস্তে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ থাকে। এখন যেই লঘুচাপটি তৈরি হয়েছে তা মঙ্গলবার (৯ই মের) মধ্যে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ১০ই মে সামুদ্রিক ঝড়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মে মাসের ১১ তারিখে পূর্ণাঙ্গ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, ঘূর্ণিঝড়টি প্রাথমিকভাবে ১১ই মে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হবে এরপর ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার উপকূলের দিকে অগ্রসর হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন মডেলও নির্দেশ করছে যে ঘূর্ণিঝড়টি ১২ মে উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলের দিয়ে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলছেন, ১২ তারিখে এটি সর্বোচ্চ শক্তিতে থাকবে এবং আমেরিকান মডেল অনুযায়ী ১৩ তারিখের দিন শেষে বা ১৪ মে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
মোখা'র সম্ভাব্য শক্তি
বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের দু’টি মৌসুম রয়েছে। একটি বর্ষার আগে অর্থাৎ এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসে এবং আরেকটি বর্ষার পড়ে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে।
সমরেন্দ্র সরকার বলছেন - “এই দুইটা সময়ে সি সার্ফেসের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। বায়ুমণ্ডলের বিন্যাস এই সময়ে ফেভারেবল থাকে। সূর্য যখন এক গোলার্ধ থেকে যখন আরেক গোলার্ধে যায় তখন এই সময়টায় বঙ্গোপসাগরের ওপরে থাকে। ফলে বঙ্গোপসাগর অতি উত্তপ্ত হয়ে যায়। এ কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠে যে পানিটা আছে সেটা সুপ্ত তাপ নিয়ে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। এটা বায়ুমণ্ডলে যত প্রবেশ করবে ঘূর্ণিঝড় তত শক্তিশালী হয় এবং এ কারণে এই সময়ে ঘূর্ণিঝড় বেশি শক্তিশালী হয়।’
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর মার্চ ও এপ্রিল মাসে মধ্য ও উত্তর বঙ্গোপাসগরে কোনো নিম্নচাপ লঘুচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়নি।
চলতি বছরে সর্বপ্রথম এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।
সে কারণে পুরো মৌসুমটায় সূর্য থেকে আগত রশ্মি পুরোটাই বঙ্গোপসাগরের পানি উত্তপ্ত করেছে , ফলে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের পানিতে।
আমেরিকার নৌবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে মোস্তফা কামাল পলাশ জানাচ্ছেন, এখন যেই স্থানে লঘুচাপটি অবস্থান করছে সেখানকার পানির তাপমাত্রা এখন ৩১ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
গত কয়েক বছর ধরে যেই কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড়টি সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার পানির মধ্যে। এখন বঙ্গোপসাগরের সমদ্রের পানির তাপমাত্রার যে মানচিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে বুঝা যাচ্ছে, যত উত্তর দিকে ঘূর্ণিঝড়টি অগ্রসর হবে তত বেশি এটি উত্তপ্ত পানির সংস্পর্শে আসবে ।
এছাড়া ঘূর্ণিঝড়টি শক্তি ধরে রাখার জন্য যে তিনটি প্রধান শর্ত প্রয়োজন তার তিনটিই আছে এবারের ঘূর্ণিঝড়ে। সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রির ওপরে এবং সমুদ্রে সঞ্চিত শক্তিযথেষ্ট পরিমাণে আছে , ফলে ঘূর্ণিঝড়টি আকারে বড় হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত করার সময় এটি অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড় কিংবা তীব্র ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। পলাশ জানান, সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি সমুদ্রে থাকা অবস্থায় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ওঠার আশঙ্কা রয়েছে ১৬০ থেকে ১৯০ কিলোমিটার। এবং উপকূলে আঘাত হানার সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ওঠার আশঙ্কা রয়েছে ১৩০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার।
তার মতে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভোলা ও নোয়াখালী এই চারটি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে ঘূর্ণিঝড়টি।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়টি হবার আগে সাগর ও আবহাওয়ার যেই পরিস্থিতি ছিল এই বছরেও তেমন পরিস্থিতির মডেলে দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন মোস্তফা কামাল পলাশ।
কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?
এই সময়টায় উপকূলীয় এলাকার জেলেদের সতর্ক করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, উপকূলীয় এলাকার কোনো জেলে ছোট নৌকা নিয়ে ৯ মে তারিখের পরে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে গভীর বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে প্রাণ নিয়ে উপকূলে ফেরার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
পলাশ বলছেন “প্রত্যেক ঘূর্ণিঝড়ের পরে দেখা যায় ট্রলারডুবির খবর। সামগ্রিকভাবে সকলের জন্য পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
কিন্তু এই পূর্বাভাস ভিন্ন ভিন্ন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন মোস্তফা কামাল পলাশ। তিনি বলেন “এখন হাতে মাত্র ৪/৫ দিন সময় আছে। উপকূল থেকে কোনো জেলে যদি গভীর সমুদ্রে যায় তাহলে তার যেতে দু’দিন আসতে দু’দিন লাগে। এখনই যদি আপনি তাদের সতর্ক না করেন তাহলে তো তারা ঝড়ের মধ্যেই পড়ে যাবে। জেলেদের নিরাপত্তার কথা কই ভাবলাম আমরা?”
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদফতর ইতোমধ্যে আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপের চারপাশে জেলেদের মাছ ধরা ও চলাচল না করার জন্য সতর্কতা জারি করেছে। সেই উদাহরণ টেনে পলাশ বলছেন উপকূলীয় এলাকার মানুষের সম্পদ যেন নষ্ট না হয় সেদিক বিবেচনায় আগে থেকে সরকারের প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।
‘ঘূর্ণিঝড়ের কথা মাথায় রেখে উপকুলীয় এলাকার দুর্বল বাঁধগুলো ঠিক করা উচিত। এখনও কোনো সতর্কতা জারি হয়নি, যে বেড়িবাঁধগুলো দুর্বল সেগুলো এই ৪/৫ দিনে ঠিক করা সম্ভব নয়।’
ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি কমানো গেলেও কৃষক, চিংড়ি চাষী, লবণ চাষীদের সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সময়ের মধ্যে কতটা নেওয়া যায় সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
সমরেন্দ্র কর্মকার বলছেন – কৃষকদের ও অন্য চাষীদের যদি এর মধ্যেই সতর্ক না করা হয় তাহলে কৃষি জমিতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হবার শঙ্কা রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি
এমইউ

















































































































































































































































































