বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। সাধারণত অতিবৃষ্টি, ঝড় এবং বন্যার মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করেই অভ্যস্ত এখানকার মানুষ। তবে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং আফটার শক হিসেবে শনিবার (২২ নভেম্বর) তিনবার কম্পন জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে।
এর মধ্যে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে ভূমিকম্প যেভাবে গোটা দেশ কাঁপিয়ে দেয়, এমন ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বাংলাদেশের মানুষ আগে কখনো হয়নি। এদিন সামাজিকমাধ্যমে বহু মানুষকে এমনই অনুভূতি প্রকাশ করতে দেখা গেছে। ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল দেশের মধ্যভাগের জেলা নরসিংদী।
বিজ্ঞাপন
গতকালের ওই ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় চারজন, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল নরসিংদীতে বাবা-ছেলেসহ পাঁচ জন এবং নারায়ণগঞ্জে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়া ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত সাড়ে চার শ’র বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের পরিবীক্ষণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের পরিচালক নিতাই চন্দ্র দে সরকার।
রাজধানীতে বাবা-ছেলেসহ চারজন নিহত
শুক্রবারের ভূমিকম্পে রাজধানীতে নিহত চারজনের তিনজনই পুরান ঢাকার। সবাই পথচারী। ভূমিকম্পের সময় বংশালের কসাইটুলী এলাকায় একটি পাঁচ তলা ভবনের রেলিং ভেঙে নিচে পড়লে তারা ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে দুজন সম্পর্কে বাবা-ছেলে। ঢাকার অন্য ঘটনাটি মুগদার মদিনা বাগের। সেখানে ভূমিকম্পে নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ধসে পড়ে মাকসুদ নামে এক নিরাপত্তাকর্মী প্রাণ হারান।
এছাড়া ভূমিকম্পে রাজধানীসহ সারাদেশের অসংখ্য ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিনের ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের তিনতলা ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের চারতলা থেকে শিক্ষার্থীরা নিচে লাফ দিলে এ ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, আহতদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থীর পা ভেঙে গেছে। তিনি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এ ঘটনার জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোববারের (২৩ নভেম্বর) সব ক্লাস এবং পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন।
নরসিংদীতে বাবা-ছেলেসহ নিহত ৫
নরসিংদীর সদর উপজেলার গাবতলী এলাকায় ভূমিকম্পের সময় বাড়ির সানশেড ভেঙে পড়ে ওমর (১০) নামে এক শিশু প্রাণ হারায়। একই ঘটনায় তার বাবা দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বলও চিকিৎসাধীন অবস্থা মারা যান।
নারায়ণগঞ্জে দেয়াল চাপায় শিশু নিহত
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভূমিকম্পের সময় একটি টিনশেড বাড়ির দেয়াল ধসে পড়ে ফাতেমা নামে এক বছর বয়সি শিশুর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় শিশুটির মা কুলসুম বেগম ও প্রতিবেশী জেসমিন বেগম আহত হন।
নরসিংদীতে উৎপত্তি হওয়া শুক্রবারের ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। এদিন ভূকম্পন অনুভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ সারাদেশের হাজার হাজার মানুষ আতঙ্কে ঘর ছেড়ে নেমে আসেন সড়কে। যারা নামতে পারেননি, তারা যে যার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ ডাকতে থাকেন। এমন অসংখ্য সিসিটিভি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, বড় ভূমিকম্পের পর অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক আফটার শক হয়। সেই নিয়ম মেনে শনিবার (২২ নভেম্বর) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিন দফায় কেঁপে ওঠে সারাদেশ।
এদিন ১২ সেকেন্ডের প্রথম ভূকম্পনটি অনুভূত হয় সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে। রিখটার স্কেলে যেটির মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। প্রাথমিকভাবে এটির উৎপত্তিস্থল সাভারের বাইপাইল বলে জানানো হয়েছিল। পরে বিকেলে ৪টার দিকে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের পেশাগত সহকারী নিজাম উদ্দিন আহাম্মাদ সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই ভূকম্পেরও উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী। তবে এবার আর কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এরপর শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যার দিকে মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দুবার ভূকম্পন অনুভূত হয় সারাদেশে। এরমধ্যে প্রথমটির মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭ এবং পরেরটির ৪ দশমিক ৩।
আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির জানান, আজ সন্ধ্যায় রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩। দুটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকার বাড্ডা এলাকা।
অন্যদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, সন্ধ্যায় আঘাত হানা ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭। এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। উৎপত্তিস্থল নরসিংদী থেকে ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে।
একই তথ্য উল্লেখ করে ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমএসসি) জানায়, ঢাকার পাশাপাশি ভূটানের রাজধানী থিম্পুতেও এই ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, ভূমিকম্পের মাত্রা ৪ দশমিক ৩।
ধারাবাহিক এমন ভূকম্পনের ফলে উদ্বেগ ও আতঙ্কে সারাদেশের মানুষ। বিশেষ করে যারা বহুতল ভবনে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এবং অফিস করেন, শুক্রবারের প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পর তাদের মনে বাড়তি আতঙ্ক ভর করেছে।
তবে বেশি ঝুঁকিতে রাজধানীর পুরান ঢাকার মানুষেরা। কারণ, সেখানকার বেশিরভাগ ভবনই অনেক পুরনো। ফলে একটু ঝাকুনিতেই বালির ঘরে মতো সেগুলো ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে ভূমিকম্প নিয়ে বাড়তি সতর্কতারই তাগিদ দিচ্ছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
এএইচ








































































































































































































































