ভয়াবহ ভূমিকম্পের দুই সপ্তাহ পার হয়েছে। তুরস্ক-সিরিয়ার বিশাল অঞ্চলজুড়ে ধ্বংসস্তূপ এখনও প্রায় তেমনই পড়ে আছে। তুরস্কের নিজস্ব বাহিনীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া উদ্ধারকারীরা এতদিন জীবিতদের খুঁজে বেড়িয়েছেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তবে দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পর সেই আশা ক্ষীণ হয়ে গেছে। গত প্রায় দুই দিনে জীবিত কাউকে উদ্ধার করা হয়নি। এমন অবস্থায় স্বজনরা আটকে পড়া ব্যক্তিদের দেহাবশেষ পাওয়ার আশা করছেন। প্রিয়জনদের কবর দিতে চান তারা।
এর আগে ২৯৬ ঘণ্টা পর ধসে পড়া ভবন থেকে শিশুসহ তিন জনকে উদ্ধার করা হয়। দক্ষিণ তুরস্ক ও সিরিয়ায় দু’বার ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটনের ১২ দিন পার হওয়ার পর শনিবার তাদের উদ্ধার করা হয়। মারাত্মক ভূমিকম্পের সংঘটনের পর ১৩তম দিনে একটি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল আন্তাকিয়া জেলার ওই ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে বেঁচে যাওয়া এ ব্যক্তিদের বের করে এনেছে।
বিজ্ঞাপন
এখন উদ্ধারকারী বাহিনী ধ্বংসস্তূপ সরানোর ও গৃহহীনদের স্থায়ী ব্যবস্থার কাজ শুরু করছে। তবে এখনও অনেক মানুষ যারা বিভিন্ন ভবনের নিচে চাপা পড়েছিল তাদের উদ্ধার করা যায়নি। এত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর স্বজনরা আটকে পড়াদের দেহাবশেষ পাবেন এবং নির্দিষ্ট স্থানে কবর দিতে পারবেন এমন আশায় রয়েছেন।
আন্তাকিয়াতে শহরটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে এটি এখন ধ্বংসস্তূপের পাহাড়ে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেকটি ভবনের ধ্বংসস্তূপ এক একটি গণকবরে রূপ নিয়েছে।
আধুনিক সময়ের সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্ক যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে তা বর্ণনাতীত। এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আফটারশকের ভয় অতিক্রম করে ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোর ভেতরে প্রবেশ করছেন উদ্ধারকারীরা। ধ্বংসস্তূপ থেকে বহু মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এক একটি ভবন যেন ‘গণকবর’
উদ্ধারকারীরা অনেক জায়গায় নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ টন টন কংক্রিটের মধ্যে ড্রিল করার জন্য পর্যাপ্ত সংস্থান নেই। এর মধ্যে কোনো মানুষের দেহ থাকলে সেটি আলাদা করে সরানো দু:সাধ্য। এখনও অনেক মানুষ তাদের স্বজনদের খুঁজে পাননি। তারা যেকোনও মূল্যে স্বজনদের দেহাবশেষ এমনকি হাড়গোড় হলেও চান। তারা চান স্বজনদের কবর দিতে।
অনেক শোকাহত পরিবারের একমাত্র আশা হলো প্রিয়জনের দেহাবশেষ পাওয়া। যাতে তারা অন্তত শোক পালন করতে পারেন এবং তার কবরে প্রতি বছর জিয়ারত করতে পারেন।
বুলডোজার অপারেটর আকিন বোজকার্ট কাহরামানমারাস শহরে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরাচ্ছিলেন। তার কাছে একজন আবদার করেন যে, 'আপনি কি একটি মৃতদেহ খুঁজে পেতে সাহায্য করবেন। পরিবারের কাছে যেন তার লাশটা পৌঁছয়।' তিনি জানান, শত শত টন ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে একটি লাশ পাওয়ার আশায় পরিবারগুলো অপেক্ষা করছে। তারা তাদের স্বজনদের জানাজা পড়াতে এবং কবর দিতে চান।
একজন সরকারি কর্মচারী বলেন, 'আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে আমরা কেবল মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে খুশি হতে পারি'। তিনি ভূমিকম্পে তার ভাই এবং শ্যালিকাকে হারিয়েছেন। তার কথায়, 'আমরা এতটাই মরিয়া যে মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার আশা শুধু বাকি আছে আমাদের।'
আরও পড়ুন: পান করেন প্রস্রাব, ছিল না শক্তি: উদ্ধার হওয়াদের রোমহর্ষক কাহিনি
ভূমিকম্পে শুধু তুরস্কে প্রায় ৩ লাখ ৩৪ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেকে এখনও নিখোঁজ। নিখোঁজদের খুঁজে পেলে নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূমিকম্পের পর থেকে তুরস্কের দশটি প্রদেশ কার্যত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। পানি ও বিদ্যুৎ নেই। ভূমিকম্প থেকে বেঁচে যাওয়া লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রায় গৃহহীন হয়ে পড়া মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। রয়টার্স জানিয়েছে, সেখানে বেঁচে যাওয়া লাখ লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।
ভূমিকম্পে এই অঞ্চলের স্যানিটেশন অবকাঠামোর বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত বা অকার্যকর হয়ে পড়ায় মানুষ যাতে রোগমুক্ত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
তুরস্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি বাতির বার্ডিক্লিচেভ সতর্ক করেছেন যে, ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত এলাকায় পানির ঘাটতি জলবাহিত রোগ এবং সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
আরও পড়ুন: কেউ ৫০, কেউ ১০০: তিন ঘণ্টায় ৬ লাখ কোটি দিল তুর্কিরা!
ফার্মাসিস্ট জিন ওজসাইগিলিও স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, 'আমরা কলেরা এবং টাইফয়েড মহামারির আশঙ্কা করছি। এই রোগগুলো প্রতিরোধ করার জন্য জরুরিভাবে ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করা উচিত।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বুধবার বলেছে যে, তারা উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার মানুষের জন্য বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। এটি একটি বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল, যেখানে সাহায্যের সামান্য সুযোগ রয়েছে।
সূত্র: আনাদুলু, আল জাজিরা ও ডন
একে