রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে প্রায় সারা বিশ্ব। যার প্রভাব ভয়াবহভাবে পড়েছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। যার ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেই সংকটকালে দেশে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের হানা। ঘূর্ণিঝড়টি সারাদেশে ব্যাপকভাবে প্রভাব না ফেললেও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
তবে অতীতের অনেক বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় তা খুব সামান্য। কারণ অতীতে বিংশ শতাব্দীতেই কয়েকটা ভয়াবহ দুর্যোগ দেখেছে দেশ। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। ১৫-২০ ফুট উচ্চতার প্রবল ঝড়টিতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার। রেডক্রসের হিসাবে সিডরে ১০ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হলেও সরকারিভাবে ছয় ছয় হাজার বলা হয়েছিল। ২০০৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আইলা। এতে প্রায় দুশোর মতো প্রাণহানি ঘটে। বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এবার ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এমন সময় আঘাত হানে যখন সরকারের পক্ষ থেকেও সংকটের কথা বলা হচ্ছে। গত ২৩ অক্টোবর দেশের জ্বালানি সংকট পরিস্থিতি নিয়ে অনেকটা হতাশা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কী হবে। আমাদের হাতে টাকা নাই। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ছয় মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি না জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে।
এদিকে দিন দিন বেড়েই চলছে লোডশেডিং। দিনের একটা বড় অংশ বিদ্যুৎ থাকছে না। আবার সমানতালে চলছে গ্যাস সংকট। রাজধানীর অনেক এলাকায় সারাদিন রান্নার গ্যাস থাকে না। একদিকে যেমন লোডশেডিং অন্যদিকে গ্যাস সংকট, সবমিলে অতিষ্ঠ জনজীবন। আবার দেশের রিজার্ভ সংকট চরমে। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে, যা ২৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বিজ্ঞাপন
এছাড়া দিনদিন বেড়েই চলছে দ্রব্যমূল্য। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন, শিগগিরই সমাধানের লক্ষণ নেই। পাশাপাশি অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে নয় হাজার ৫৯ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজড ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা। এখানে শুধু খাবারের হিসাবের কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য জিনিস তো আছেই।
সবমিলে বলাই যায় একটা সংকটের মধ্যে আছে দেশ ও দেশের মানুষ। সেই মুহূর্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হানা। সোমবার (২৪ অক্টোবর) দিবাগত রাতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং উপকূল হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা অতিক্রম করে। ভোররাতে এটি দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়। এর প্রভাবে সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় ৩৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। আশ্রয়েকেন্দ্রে আশ্রয় নেয় প্রায় ১০ লাখ মানুষ। তাৎক্ষণিক ৮০ লাখের বেশি গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
আর্থিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখন পর্যন্ত না জানা গেলেও অতীতের বড় বড় সুপার সাইক্লোনের ক্ষয়ক্ষতির যে ধারেকাছেই যায়নি সেটা পরিষ্কার। তবে সিত্রাং আঘাত হানার আগে এটাকে অনেক বিধ্বংসী হিসেবে ধারণা করা হচ্ছিল। অনেকে বলেছিলেন, এটা সুপার সাইক্লোনে রূপ নিতে পারে। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন, আয়লা-সিডরের থেকেও ভয়াবহ হতে পারে। তবে সেই দুর্যোগের হাত থেকে অবশেষে রক্ষা পেয়েছে দেশ।
বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের নেতারা বলছেন, দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বড় কোনো দুর্যোগ এলে তা দেশের অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ চাপ পড়ত। সেই জায়গা থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সিত্রাং নামের যে ঘূর্ণিঝড়টা আমাদের দেশের ওপর দিয়ে গেল, আমি মনে করি এটা থেকে মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেছেন। কারণ একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি যেটা পর্যবেক্ষণ করি, এই ঘূর্ণিঝড়টা আঘাত হেনেছে ভাটার সময়। যে সময় জলোচ্ছ্বাস হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। এটা যদি জোয়ারের সময় আঘাত হানত তবে অনেক বড় ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন সময় এই ধরনের দুর্যোগ সুন্দরবন এলাকা হয়ে আসে, ফলে সুন্দরবন সেটাকে প্রোটেক্ট করে। কিন্তু এবার যেহেতু অন্যদিক দিয়ে আসছিল তাই ঝুঁকিটাও বেশি ছিল। আর যদি দেশের এই সংকটকালীন মুহূর্তে বড় কোনো দুর্যোগ হতো তবে খুব কঠিন অবস্থা তৈরি হতো। সবমিলে আমি বলবো, আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।’
প্রত্যক্ষভাবে সিত্রাং খুব বেশি প্রভাব না ফেললেও তা পরোক্ষাভাবে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ অনেক বেশি ক্ষতি করছে বলে মনে করছেন জলবায়ু গবেষকরা। পরিবেশবিদ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন মানুষ বন্যা বা এই ধরনের দুর্যোগের সাথে খাইয়ে নিতে পারত। বন্যার পরে কৃষি জমিতে একটা পজেটিভ অবস্থা তৈরি হতো। পরবর্তী তিন-চার বছর ফসল ভালো হতো। কিন্তু এখন সেটার বিপরীত হচ্ছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যার ফলে সেই লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে প্রবেশ করছে। এতে জমির ঊর্বরতা কমে যাচ্ছে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাই আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে হবে। কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে হবে তা আমরা অনেকবার বলেছি। বিশেষ করে পরিবেশ দূষণ কমাতে হবে। বেশি করে বনায়ন সবুজায়ন বাড়াতে হবে।’
টিএই/জেবি