আগামী ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন বেশ জমজমাট ছিলো বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর ছিল গোটা নয়াপল্টন। দিনভর মিছিল শেষে রাতে সবার গল্প-আড্ডা আর সমাবেশের দিনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাটত সময়। মঙ্গলবার থেকে আগত নেতাকর্মীদের জন্য খাবারেরও আয়োজন করা হয়। কিন্তু সবকিছু যেন হঠাৎ ঝড়ে উলোটপালোট হয়ে গেছে। পুলিশের সঙ্গে বুধবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুরে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের পর এখন জনমানবশূন্য নয়াপল্টনের কার্যালয়।
শুধু তাই নয়, সংঘর্ষ থামার পর পুলিশি অভিযানে অনেকটা তছনছ হয়ে গেছে পুরো কার্যালয়। বিকেলে কার্যালয়ের ভেতর থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম, আমান উল্লাহ আমান, রুহুল কবির রিজভী, খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ প্রায় ৩ শতাধিক নেতাকর্মীকে।
বিজ্ঞাপন
পুলিশের দাবি, নাশকতার পরিকল্পনা করে বিএনপি সমাবেশের কয়েকদিন আগে থেকে নয়াপল্টনে ককটেলসহ অনেক কিছু জড়ো করেছে। যে কারণে তারা বাধ্য হয়ে অভিযান চালিয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার বিশ্বাস বলেছেন, নয়াপল্টনে অভিযানের পরিকল্পনা না থাকলেও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার পরই সেখানে পুলিশি অভিযান চালানো হয়েছে।
তার দাবি, অভিযানে অসংখ্য বোমা জব্দ করা হয়েছে। যখন আমরা কার্যালয়টির সামনে অবস্থান নিয়েছি তখন আমাদের উদ্দেশ্য করে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। যখন অসংখ্য সাংবাদিক ও আমাদের পুলিশ সদস্যরা আহত হচ্ছে, যখন জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, আমরা কিন্তু অভিযান চালানোর জন্য এখানে আসিনি কিন্তু যখন আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে তখন আমরা অভিযান চালাতে বাধ্য হয়েছি।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ, পুলিশ জোরপূর্বক কার্যালয়ে প্রবেশ করেছে। নিজেরা ককটেল নিয়ে বিএনপিকে দোষারোপ করছে।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাতে নয়াপল্টন ছাড়ার সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘অন্যায় ও পাশবিকভাবে বিএনপি নেতাদের ওপর হামলা ও আটক করা হয়েছে। পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়ে ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরাই ব্যাগে করে বিস্ফোরক এনে এখন মিথ্যে তথ্য দিচ্ছে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারকটা নানা উস্কানিমূলক বক্তব্যে বলেছিলেন যে, এমন ঘটনা ঘটাবেন। এটা শুধু বিএনপির ওপর আঘাত নয়, দেশ ও গণতন্ত্রের ওপর আঘাত। সরকার পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
ফখরুল বলেন, পুলিশ সব ডকুমেন্ট নিয়ে গেছে লাইট, সিসি ক্যামেরা ভেঙেছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না।
যেমন আছে বিএনপি কার্যালয়
অভিযান শেষে রাত নয়টার পর কার্যালয়ে ঢোকার সুযোগ পান সাংবাদিকরা। কিন্তু পুলিশি অভিযানে পুরো তছনছ হয়ে যাওয়া কার্যালয় দেখে মনে হয় একটা ভুতের বাড়ি!
বিএনপি মহাসচিবের রুমসহ বেশিরভাগ রুমের দরজা ভাঙা। আসবাব পত্র ছিন্নভিন্ন। আর নেতাকর্মীদের জন্য রান্না করা খিচুড়ি, চাল-ডাল ও পানির হাজার হাজার বোতল পানি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়।
সংঘর্ষের লম্বা সময় পরও কার্যালয়ের মধ্যে টিয়ারগ্যাসের ঝাঁঝ চোখমুখ বিষিয়ে তোলে সবার।
কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, নিচতলায় গেটের পাশেই স্থাপন করা কাঁচে ঘেরা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙা অবস্থায়।
দ্বিতীয় তলায় আছে মহিলা দলের কার্যালয়। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে চেয়ার-টেবিলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। একটি কক্ষে স্তূপ করে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায় অসংখ্য পানির বোতল।
তৃতীয় তলায় বিএনপি মহাসচিবের রুম। সেটির দরজাও ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। একই ফ্লোরে রুহুল কবির রিজভীর রুমের কাঁচের দরজাও ভাঙা দেখা যায়।
পাশের দফতরের কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়।
এর আগেও একবার বিএনপি কার্যালয় থেকে শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের সময় মির্জা ফখরুলের রুম ভাঙা হয়েছিল।
চতুর্থ তলায় ছাত্রদল, যুবদল ও কৃষকদলের কার্যালয় অবস্থিত। সেখানেও আসবাবপত্র এলোমেলা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
মেঝেতে কিছু কাপড়ের পোড়া অংশ পাওয়া গেছে। টিয়ার শেলের ঝাঁজ থেকে মুক্তি পেতে কাপড় পোড়ানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
পঞ্চম তলায় জাসাসের কার্যালয় এবং ষষ্ঠ তলায় জিয়া স্মৃতি পাঠাগার। অন্যান্য তলার মতো এই দুই তলাতেও আসবাবপত্র ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় পাওয়া যায়।
এদিকে সংঘর্ষ থামার পর পুলিশের পক্ষ থেকে ফকিরাপুল এবং নাইটিঙ্গেল মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। সাধারণ মানুষেরও উপস্থিতি দেখা যায় খুব অল্প। তবে পুরো এলাকায় পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি ছিলো।
এছাড়াও পুলিশের রায়টকার ও এপিসি তার রাখা আছে নয়াপল্টনে।
এদিকে রাত বাড়ার পর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে পুরো এলাকার ময়লা পরিষ্কার করে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে বিএনপি এখনো নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে আছে। তবে পুলিশ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে কোনোভাবেই সড়কে তাদের সমাবেশ করার সুযোগ দেবে না। বরং অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত গোটা নয়াপল্টন পুলিশের দখলেই থাকছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সে কারণে সহসাই বিএনপি কার্যালয় আগের মতো সচল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন খোদ নেতাকর্মীরা।
বিইউ/এএস