চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় পাঁচ লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু পাহাড় আর সাগর ঘেষা এই উপজেলাটিই যেন হয়ে উঠেছে এক মৃত্যু ফাঁদ।
উপজেলায় ভারি শিল্প-কারখানা আছে তিনশ’র বেশি। এসব শিল্প-কারখানাগুলোর অধিকাংশই আবার উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থ এবং রাসায়নিক ব্যবহার করে। কিন্তু কারখানাগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা বলতে গেলে প্রায় কিছুই নেই।
বিজ্ঞাপন
ডয়েচে ভেলে (বাংলা) এক প্রতিবেদনে জানায়, সীতাকুণ্ড উপজেলায় দুইটি ফায়ার স্টেশন আছে, যাতে সব মিলিয়ে কর্মী রয়েছেন প্রায় ৩০ জন। প্রচলিত ফায়ার ফাইটিং যন্ত্রপাতির বাইরে বিশেষ কোনো যন্ত্রপাতিও নেই। আগুন নিয়ন্ত্রণে গাড়ি আছে ছয়-সাতটি।
সর্বশেষ শনিবার (৪ মার্চ) সীমা অক্সিজেন লিমিটেড নামে একটি অক্সিজেন তৈরির প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হয়েছেন। কিন্তু বিস্ফোরণ এত শক্তিশালী ছিল যে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে বিস্ফোরিত অংশ আঘাত করে তাতে একজন নিহত হন।
এর চেয়েও ভয়াবহ এক পরিস্থিতি হয়েছিল গত বছরের ৪ জুন এই সীতাকুণ্ডেরই বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুনের ঘটনায়৷ তখন দমকলকর্মীসহ ৫১ জন মারা যান৷ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তখন কয়েক কিলোমিটার জুড়ে কেঁপে উঠেছিল৷ ওই ডিপোতে অগ্নি নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷
বিজ্ঞাপন
শনিবার সীমা অক্সিজেন লিমিটেডে যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে প্রথমে বিস্ফোরণ এবং তারপরই আগুন লাগে৷ জানা গেছে, ওই প্ল্যান্টের যন্ত্রপাতি মেয়াদ উত্তীর্ণ।
সীতাকুণ্ড হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমরা রীতিমত মৃত্যুকূপে বসবাস করছি৷ এখান থেকে বেহেশত আর দোজখ দুই জায়গায়ই যাওয়া সহজ৷ একটি উপজেলায় কয়েকশ ভারি শিল্প আছে, যার মধ্যে প্রাইভেট কন্টেইনার. এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট, কেমিকেল কারখানা, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড নানা ধরনের বিপজ্জনক শিল্প কারখানা আছে৷ কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই লোকালয়ে এসব শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়েছে।'
তিনি জানান, এখানে ১২৬টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড আছে। এলপিজি-এলএনজি কারখানা আছে ২০টি, কেমিকেলসহ দেড়শতাধিক বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় কারাখানা আছে৷ এর মধ্যে আছে অক্সিজেন প্ল্যান্ট, রিরোলিং মিলসহ আরো অনেক কারখানা। কন্টেইনার ডিপো আছে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০টি।
তার কথা, এই প্রত্যেকটি কারাখানা বিপজ্জনক৷ এখানে গ্যাস, কেমিকেল, গ্যাস, গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিস্ফোরক এবং নানা দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোনো সেইফটি-সিকিউরিট বা অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাই। আর লোকালয়ে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা না করেই এসব বিপজ্জনক শিল্প কারখানা তৈরি করা হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, ১৭টি প্রতিষ্ঠান আছে এসব দেখার কিন্তু কেউ দেখে না। এইসব কারখানা কীভাবে অনুমোদন পায় বুঝতে পারি না। এলাকার লোকজনও এখন এটা মেনে নিয়েছে।
ফয়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক সেলিম নেওয়াজ ভুঁইয়া বলেন, বিএম ডিপোতে আগুনের সময়ও দেখেছি ওই এলাকায় অগ্নি নিরপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই৷ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও প্রাণ হারিয়েছে। একটি উপজেলায় এতগুলো বিপজ্জক কারখানা থাকলেও কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই৷ আর কারখানাগুলোর নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক আলি আহমদ খান বলেন, সবশেষ যেটা হয়েছে তা হলো অক্সিজেন প্ল্যান্টটিই বিস্ফোরিত হয়েছে। এটার মেয়াদ ছিল কিনা তা যাদের দেখার তারা দেখেননি৷ সীতাকুণ্ডে এর আগে কন্টেইনার ডিপোতে আগুনে অনেক লোক মারা গেল। ওই এলাকায় অনেক বিপজ্জনক কারখানা আছে। কিন্তু যাদের দেখার তারা দেখছে না৷ ওইগুলোর কমপ্লায়েন্স আছে কিনা তাও দেখা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমি একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, এইরকম এলাকার জন্য বিশেষ ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। সীতাকুণ্ডের মতো একটি এলাকায় লোকালয়ে এই ধরনের শিল্প গড়ে তোলার অনুমতিও বিপজ্জনক।
সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এস এল আল মামুন বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ছাড়া বলা যাবে না এখানকার শিল্প কারখানাগুলোর সব ধরনের অনুমোদন আছে কী না। অনুমোদন না থাকলে তারা আছে কিভাবে?
তবে তিনি বলেন, আমার এই উপজেলায় ৩২৫টির মতো শিল্প-কারখানা আছে, লোকালয়েও আছে৷ আমরা বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে আছি৷ কিন্তু যারা অনুমোদন দিয়েছেন তারা কিভাবে দিয়েছেন তারাই বলতে পারবেন।
/জেএম