সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

অপরিকল্পিত শিল্পায়নে অগ্নিগর্ভ সীতাকুণ্ড

এম আই খলিল
প্রকাশিত: ১২ মার্চ ২০২৩, ০৫:৫২ এএম

শেয়ার করুন:

অপরিকল্পিত শিল্পায়নে অগ্নিগর্ভ সীতাকুণ্ড

একদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অন্যদিকে সাগরপথ। যোগাযোগের এমন সুবিধায় শিল্প গ্রুপগুলোর নজর পড়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায়। ফলে নগরীর ফৌজদারহাট থেকে সীতাকুণ্ডের শেষ সীমানা পর্যন্ত একের পর এক নীরবে গড়ে উঠে বিভিন্ন শিল্প কারখানা। কিন্তু এতো শিল্প কারখানা স্থাপন হলেও সেগুলোতে পরিবেশ সংরক্ষণ, অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, রাসায়নিক বিক্রিয়া সংক্রান্ত নিরাপত্তা ও শ্রম নিরাপত্তা আইন সংক্রান্ত যেসব বিধান রয়েছে তার কোনটাই মানা হয়নি। ফলে সীতাকুণ্ডের শিল্পকারখানাগুলোতে প্রায়ই ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের বড় বড় ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় ঘটছে প্রাণহানিও। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এমন বিপদজনক শিল্পায়নে সীতাকুণ্ড অনেকটা অগ্নিকুণ্ড হয়ে উঠেছে।

গতকাল শনিবার (১১ মার্চ) বিকেলে এসব কথা বলেন সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আজিজ। তিনি বলেন, সীতাকুণ্ড এখন রীতিমত জলন্ত অগ্নিকুণ্ড। মৃত্যু কবুল করেই বসবাস করছি আমরা। এখানে রয়েছে কয়েকশ ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে প্রাইভেট কন্টেইনার. এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট, কেমিকেল কারখানা, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডসহ নানা ধরনের বিপদজনক শিল্প কারখানা আছে।


বিজ্ঞাপন


সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত প্রাণহানির খবর আসে সীতাকুণ্ডের শিপ ইয়ার্ডগুলোতে। যেখানে জাহাজের ওপর থেকে পড়ে ঘটছে মৃত্যু, না হয় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বা ভল্কানিতে, না হয় জাহাজ কাটার সময় লোহার পাত পড়ে ঘটছে মৃত্যু। এরপর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে স্টিল রি-রোলিং মিলগুলোতে। যেখানে হয় চুল্লিতে পুড়ে, না হয় জলন্ত লোহার পাতে দ্বগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে অহরহ শ্রমিক।

এর মধ্যে বড় দুটি দুর্ঘটনার খবর দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর গতকাল শনিবার (১১ মার্চ) সকালে সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা এলাকায় ইউনিটেক্স গ্রুপের তুলার গুদামে আগুন লাগার ঘটনাটি ছিল সর্বশেষ ঘটনা। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট রাত ১২টা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। আগুন না নেভায় হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কেও কোন তথ্য দিতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস।

সীতাকুণ্ডের যে দুটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল তার একটি ঘটে গত ৪ মার্চ। সেদিন বিকেলে সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড কারখানায় হঠাৎ বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে যায়। এ সময় ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠে কারখানার আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত।


বিজ্ঞাপন


‍sitakunda-2খবর পেয়ে চট্টগ্রাম ও সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট কারখানায় গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। একইসঙ্গে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশসহ স্থানীয় অনেক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। যাদের মধ্যে অন্যতম গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ।

ওইদিন রাত ৯টা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযানে তারা সীমা অক্সিজেন কারখানার অভ্যন্তর থেকে চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করে। যাদের শরীর ছিল ছিন্ন-ভিন্ন। প্রথমে এদের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারলেও মধ্যরাতে এদের স্বজনরা চমেক হাসপাতালে এসে মরদেহ শনাক্ত করে। তারা হলেন- মো. ফরিদ (৩৬), রতন লখরেট (৪৫), আব্দুল কাদের (৫০) ও সেলিম রিসিল (৪৫)।

এছাড়া কারখানাটির আধা কিলোমিটার দূরে সালাউদ্দিন (৩৩) নামে এক ব্যক্তি এবং এক কিলোমিটার দূরে ফৌজদারহাট ভাটিয়ারি এলাকায় একটি চা দোকানে বসা অবস্থায় সামশুল আলম (৫৬) নামে এক ব্যক্তি মারা যায়। কারখানায় বিস্ফোরণের সময় লোহার পাত উড়ে এসে এই দুই ব্যক্তির ওপর পড়লে তাদের মৃত্যু হয়।

‍sitakunda-3ওই ঘটনায় আহত হন অন্তত ৩০ জনের মতো। যাদের মধ্যে ২০ জন দগ্ধ হয়ে এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন।

এর চেয়েও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল গত বছরের ৪ জুন রাতে। সেদিন সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুনে একের পর বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় ১১ দমকলকর্মীসহ নিহত হন ৫১ জন। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তখন কয়েক কিলোমিটার জুড়ে কেঁপে উঠে।

শুধু সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট বা বিএম কন্টেইনার ডিপো, রি-রোলিং মিল বা শিপ ইয়ার্ড নয়, সীতাকুণ্ডে এমন শত শত কারখানা আছে যেগুলোর কোনরকম অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পরিবেশ সংরক্ষণ, শ্রমিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ বিধি মোতাবেক কোন ব্যবস্থা নেই।

সীতাকুণ্ডে কত শিল্প প্রতিষ্ঠান তার সঠিক তথ্য নেই

শিল্প প্রতিষ্ঠান তদারকির কথা কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতরসহ সরকারি আরও কয়েকটি সংস্থার। কিন্তু সেই সংস্থাগুলোর কাছে নেই সীতাকুণ্ডে কতগুলো শিল্প কারখানা আছে তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। একেক সংস্থার হিসেবে দেখা যায়, একেক রকম তথ্য।

এর মধ্যে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতরের চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত জানান, সীতাকুণ্ডে ৫৭৫টি কারখানার নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান চালু করেনি। নিবন্ধনের বাইরে কতগুলো আছে, তা তার জানা নেই। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পুরো চট্টগ্রাম জেলায় নিবন্ধন নিয়েছে ৪৯৪৮টি কল-কারখানা। চালু আছে ২০৩২টি।

আর সীতাকুণ্ডের ইউএনও শাহাদাত হোসেন বলেন, তহশিলদারদের মাধ্যমে আমরা একটা জরিপ করেছিলাম। সীতাকুণ্ডে মোট ১৭৯টি শিপ ইয়ার্ড, ছোট-বড় ৫০টি কন্টেইনার ডিপো, ২০টি এলপিজি-এলএনজি কারখানাসহ ৪৮০টি ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

‍sitakunda-5

কারখানার সংখ্যা নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, আমাদের মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের তথ্য আছে। সেটা কত এখনই বলতে পারছি না। তথ্য নিয়ে পরে জানাতে পারব।

তিনি বলেন, সাগর ও পাহাড়বেষ্টিত সীতাকুণ্ড উপজেলায় শিপইয়ার্ড, কন্টেনার ডিপো, অক্সিজেন প্ল্যান্ট, স্টিল রি রোলিং মিল, তেল ডিপো, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা, পুরনো জাহাজের তেল টায়ার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মজুদ ও কাটার প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা আছে। এর মধ্যে গত বছর আমরা ৫৪টি পরিদর্শন করেছি। সেখানে কিছু নির্দেশনা দিয়ে আসি।

নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা

ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, দুর্ঘটনাকবলিত সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। এর আগে বিএম কন্টেনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডেও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ফলে এই দুই কারখানায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত প্রতিষ্ঠানটির ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে পর্যন্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। যার জন্য ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স পরিদর্শনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের মালিককে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বার বার তাগাদা দিয়েছিল।

chittagong-

এভাবে সীতাকুণ্ডে স্থাপিত সিংহভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিজেদের কোন অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নেই। এসব প্রতিষ্ঠানকে বার বার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও তাতে তারা কর্ণপাত করছে না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে অগ্নি ঝুঁকি বাড়ছে। এতে ক্রমেই অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটছে।

ঠিক নেই অন্যান্য কাগজপত্রও

পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের অধীনে পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। তবে তা নবায়ন করেনি প্রতিষ্ঠানটি। দুর্ঘটনার পর পরিবেশ অধিদফতরের টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, শুধু সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট নয়, সীতকুণ্ডসহ চট্টগ্রামের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেই। কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানে থাকলেও তা নবায়ন করেনি। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।

সীতাকুণ্ড উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশরাফুল আলম বলেন, সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের পর আমরা উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তাই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি। এ বিষয়ে আমরা খোঁজ-খবর নেব। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রও সঠিক আছে কি না আমরা যাচাই করব। তবে এতগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান তদারকি করা উপজেলা প্রশাসনের একার পক্ষে সম্ভব নয়।

বিস্ফোরক অধিদফতর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, অক্সিজেন কারখানাটিতে বিস্ফোরক অধিদফতরের লাইসেন্স আছে কিনা তা আমার জানা নেই। লাইসেন্স দেওয়া হয় ঢাকা কার্যালয় থেকে। সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হবে। তথ্য পাওয়ার পর আমরা ব্যবস্থা নেব।

‍sitakunda-4

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান বলেন, সীতাকুণ্ডে কাগজে কলমের চেয়েও অনেক বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে শুনেছি। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে একের পর দুর্ঘটনায় আমরা সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।

জেলা প্রশাসক বলেন, সীতাকুণ্ডে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন ক্যাটাগরিতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ (লাল), মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ (হলুদ) ও কম ঝুঁকির (সবুজ) শিল্প-কারখানার তালিকা করতে ফায়ার সার্ভিস, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর এবং বিস্ফোরক অধিদফতরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো সার্ভে করা হচ্ছে। শতভাগ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত না করে যেন নতুন কারখানা চালু না হয়। আর চালু কারখানাগুলোকে কীভাবে কমপ্লায়েন্সে আনা যায়, সেটার ক্রাশ প্রোগ্রাম করব।

আইকে/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর