চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। প্রতিবেদনে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় ৫১ জনের মৃত্যুর জন্য ‘কেউ দায়ী নয়’ উল্লেখ করে বিএম ডিপোর ৮ কর্মকর্তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
শুক্রবার (৫ মে) চট্টগ্রামের এসপি এস এম শফিউল্লাহ এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার (৪ মে) পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এটি একটি ‘মিস্টেক অব ফ্যাক্ট’ বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনার জন্য ৮ জন কর্মকর্তা দায়ী নয়। তাদের দায়িত্বেও কোনো অবহেলা ছিল না। এটা একটা দুর্ঘটনা।
বিজ্ঞাপন
চট্টগ্রামের এসপি বলেন, তদন্ত শেষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিবির পরিদর্শক মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী চূড়ান্ত প্রতিবেদন লিখেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযুক্তরা ঘটনার জন্য দায়ী নয় বা বিস্ফোরণটি কোনো নাশকতা নয়। এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল। এ ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানায় দায়ের করা মামলাটি ‘তথ্যগত ভুল’ উল্লেখ করা হয়েছে।
গত বছরের ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনায় ৫১ জন নিহত হওয়া ছাড়া দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। বিস্ফোরণের তিন দিন পর ৭ জুন সীতাকুণ্ড থানায় ডিপোর আট কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন সীতাকুণ্ড মডেল থানার উপপরিদর্শক আশরাফ সিদ্দিক।
সেই মামলায় ডিপোর উপমহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) নুরুল আক্তার, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমান, সহকারী প্রশাসন কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র নির্বাহী (প্রশাসন ও অভিযোগ) মো. নাসির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো) মো. আব্দুল আজিজ, ইনচার্জ (কনটেইনার মালবাহী স্টেশন) সাইদুল ইসলাম, কনটেইনার ও মালবাহী স্টেশনের নজরুল ইসলাম এবং উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) নাজমুল আক্তার খানকে আসামি করা হয়।
ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে মামলাটি দায়ের করেছিল সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ। দায়িত্বে সম্পূর্ণ অবহেলায় বিস্ফোরণের সূত্রপাত বলে এতে অভিযোগ করা হয়েছিল। মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল, অভিযুক্তরা প্রয়োজনীয় এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ না নিয়ে ডিপোতে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণ করেছিল। এতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের কারণে মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। অভিযুক্তদের অবহেলায় জানমাল ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
এমনকি ওই ঘটনার পর চট্টগ্রামের বিভাগীয় অফিসের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি ৩০০ পৃষ্ঠা সংযুক্ত করে তাদের ১৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে ২০টি সুপারিশ করেছিল। পাশাপাশি তদন্ত কমিটি সরকারের বিভিন্ন পক্ষের অবহেলা এবং মালিকপক্ষের অবহেলাকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছিল।
ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৫ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়সহ আটটি বিভাগকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠিও দেন।
শনাক্ত না হওয়া ৮ মরদেহ দাফন
বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকা মরদেহগুলোর মধ্যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও আটজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এমনকি মরদেহগুলো নিতে কেউ আবেদনও করেননি। ফলে আদালতের অনুমতি নিয়ে নগরীর বাইশ মহল্লা কবরস্থানে মরদেহগুলো আঞ্জুমান-ই-মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করেছে নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
এ বিষয়ে নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওসি নুর আহমেদ বলেন, বিএম ডিপো বিস্ফোরণ মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর তাঁরা মর্গে পড়ে থাকা ৮টি মরদেহের পরিচয় শনাক্তে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহসহ যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও মরদেহের পরিচয় শনাক্তে ব্যর্থ হন তাঁরা। এমনকি দীর্ঘ ১০ মাস অপেক্ষার পরও মর্গে পড়ে থাকা মরদেহগুলো ফিরে পেতে কোনো স্বজনেরা যোগাযোগ করেননি। পরে বেওয়ারিশ হিসেবে মরদেহগুলো দাফন করতে আদালতের শরণাপন্ন হই। একপর্যায়ে আদালত অনুমতি দিলে গত ২০ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগরীর বাইশ মহল্লা মসজিদে মরদেহগুলো দাফন করা হয়।
ওসি আরও বলেন, আদালতের অনুমতি নিয়ে বেওয়ারিশ মরদেহগুলো তাঁরা কবর দিয়েছেন এবং সেই স্থানটিকে চিহ্নিত করে রেখেছেন। তবে কোনো স্বজন যদি মরদেহ ফিরে পাওয়ার দাবি নিয়ে আসেন, তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর নিহত ৫১ জনের মরদেহ উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৯টি মরদেহ নিহতদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে মর্গে থাকা ২২টি মরদেহের বেশিরভাগই দগ্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং চেহারা বিকৃত হওয়ায় তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। স্বজনেরা কোনোভাবেই মরদেহগুলো শনাক্ত করতে পারেননি। পরে গত বছরের ৭ জুন এসব মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য স্বজনদের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। ওই সময় আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া ২২টি মরদেহ ফিরে পেতে ডিএনএ নমুনা দেন ৩৫ জন।
তবে নমুনা সংগ্রহের এক মাস পর আটটি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হলে স্বজনদের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়। বাকি থাকে আরও ১৪ জনের মরদেহ। পরবর্তীকালে গত বছরের অক্টোবরে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষায় পরিচয় শনাক্তের পর আরও ছয়জনের মরদেহ তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় করা মামলা ও মর্গে থাকা মরদেহের পরিচয় শনাক্তের কাজ তদারকি করেন তৎকালীন সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক। তিনি মামলার তদন্তকাজ এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে পুড়ে অঙ্গার হওয়া পরিচয়বিহীন ২২ মরদেহের মধ্যে ১৪টি মরদেহ পরিচয় শনাক্ত করে তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন। তবে গত বছরের ২৯ অক্টোবর তিনি সীতাকুণ্ড থানা থেকে অন্যত্র বদলি হলে মামলাটি নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর আর বাকি আটজনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিনিধি/আইএইচ