পেশাগত কাজ করতে গিয়ে শনিবার (৪ জুন) সারারাত নির্ঘুম কেটেছে বেসরকারি টেলিভিশনের চট্টগ্রামে কাজ করা সাংবাদিক আরিফ হোসেনের। একদণ্ড বিশ্রামের সুযোগ হয়নি। রাতের আঁধার কেটে নতুন দিনে সূর্য উদয় হলেও সীতাকুণ্ডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল ছাড়তে পারেননি তার মতো অসংখ্য গণমাধ্যমকর্মী। কারণ রোববার (৫ জুন) বেলা ১টা পর্যন্তও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি আগুন। সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে পোড়া মানুষের লাশের সংখ্যা।
২৫ একর জমির উপর গড়ে ওঠা সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ডে রোববার দুপুর পর্যন্ত ৩৭ জনের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন কয়েকশ।
বিজ্ঞাপন
এত গেল সংবাদকর্মীদের অবস্থা। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে যারা আগুন নেভাতে কাজ করছেন তাদের কথা তো ভাবাই যায় না। কারণ চট্টগ্রামসহ মোট ২৫টি ইউনিটের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন। দম ফেলারও সুযোগ পাননি তারা। এমন ভয়াবহ আগুন নেভাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সাতজন কর্মী। আহত হয়েছেন ২১ জন সদস্য।
তাদের সঙ্গে পুলিশ, র্যাবের সদস্যরাও ঘটনাস্থলে থেকে অবিরাম পরিশ্রম করে গেছেন শনিবার রাত থেকে।
চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। কারণ একসঙ্গে এত আগুনে পোড়া রোগী দেখেনি চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলো। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বেসরকারি সব মেডিকেলে যে যেভাবে পারছেন রোগী নিয়ে ছুটছেন। তারাও নিরলসভাবে চেষ্টা করছেন রোগীদের সেবা দিতে।
এরই মধ্যে সিভিল সার্জন অফিস থেকে চট্টগ্রামের সব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বলা হয়েছে, শুধু এপ্রোন পরে হাসপাতালে চলে আসতে।
বিজ্ঞাপন
যেমন নির্দেশনা তেমন কাজ করেছেন চিকিৎসক, নার্সরা। শেষ সামর্থ্যটুকু দিয়ে আগুনে দগ্ধ মানুষের কষ্ট লাঘবে কাজ করেছেন তারা।
এমন বিপদে পিছিয়ে থাকেননি সাধারণ মানুষও। বিশেষ করে রেড ক্রিসেন্টসহ স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এসেছেন দুর্ঘটনাস্থলে।
কেউ রক্তের জন্য এগিয়ে এসেছেন, কেউ আবার রোগীদের সিএনজি, অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, কেউ আবার আগুনে ভস্ম হয়ে যাওয়া মৃতদেহগুলো একে একে বের করে নিয়ে আসছেন।
বিশেষ করে ‘গাউছিয়া কমিটি’ নামের একটি সংগঠনের প্রায় এক হাজারের মতো স্বেচ্ছাসেবক শনিবার থেকে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সমন্বয়ক মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার। তিনি বলেন, আমরা গতকাল থেকে অগ্নিদগ্ধদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এখন মারা যাচ্ছে তাদের লাশ উদ্ধার করছি। প্রয়োজনে আমাদের সংগঠনের আরও কর্মী এখানে যোগ দেবে।
আগুনের লেলিহান শিখা কিছু কমে এলেও এখন কেমিক্যালের কারণে সীতাকুণ্ডের আকাশে কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। বাতাসে উৎকট গন্ধের কারণে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে।
মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার বলেন, আমি নিজেও চোখে-মুখে পানি দিয়ে এলাম। কারণ চোখ খুলে তাকানো যায় না। আমাদের সংগঠনের ১২ জন আহত হয়েছেন।
রোববার সকালে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারে থাকার সময় একে একে লাশ উদ্ধার দেখে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে যান একজন সংবাদকর্মী। একদিকে ক্লান্ত শরীর, অন্যদিকে মর্মান্তিক এমন দুর্ঘটনার কারণে মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও পেশাগত কাজ চালিয়ে গেছেন ওই প্রতিবেদক।
বারবার তাকে বলতে শোনা যায়, আমরা একটাও দুঃসংবাদ দিতে চাই না। সুসংবাদ দিতে চাই। কিন্তু নির্মম পরিহাস বারবার দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে। একটু পরপর লাশ বের হচ্ছে। অথচ কেউ কাউকে চিনেন না। পরিচয়ও জানেনও না।
‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই বিপদে এগিয়ে এসেছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর সাধারণ মানুষের এভাবে এগিয়ে আসাকে মানবিকতা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করছেন সবাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের প্রশংসা করছেন।
চট্টগ্রামে ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রইচ উদ্দিন ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতে বিশ্রাম নেওয়া সাংবাদিকদের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন।
পোস্টে তিনি লিখেছেন, 'উনি একজন সংবাদযোদ্ধা। বাংলাদেশের অতি পরিচিত একটা সংবাদ চ্যানেলের অতি পরিচিত প্রিয়মুখ। সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের খবর সংগ্রহ করতে অন্যান্য সংবাদকর্মীদের ন্যায় সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন তিনি। ক্লান্তিতে শরীরে ঝিমুনি আসায় ফুটপাতে বসেই সামান্য বিশ্রাম নিচ্ছেন নতুন উদ্যমে সংবাদ সংগ্রহের যুদ্ধে। স্যালুট তোমায় হে প্রিয় সহযোদ্ধা।'
শুধু তারাই নন, আরও অনেকে নানাভাবে এগিয়ে এসেছেন সীতাকুণ্ডে বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও তাদের কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল, দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় উপস্থিত হযতে দেখা গেছে।
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে হাসপাতালে আসা রোগীদের রক্তসহ কোনো ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে ফোন নম্বরও দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পক্ষ থেকে তাদের নেতাকর্মীদের বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।
রক্তের জন্য বাস ঝুলে হাসপাতালে ছুটেছেন শিক্ষার্থীরা
এদিকে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ ও হতাহতদের রক্তের প্রয়োজনের কথা জানতে পেরে রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের উদ্দেশে ছুটে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কয়েকশ শিক্ষার্থী।
শনিবার (৪ জুন) দিবাগত রাত ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি বাস ও একটি অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করা হয় মেডিকেলের উদ্দেশে যাত্রার জন্য। সে সময়ই দেখা মেলে চবি শিক্ষার্থীদের মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। দুটি গাড়িতে জায়গা না পেয়ে অনেকেই কোনোরকম ঝুলে ও অন্য উপায়ে মেডিকেলের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
এদিকে হঠাৎ বিপুলসংখ্যক রোগীর চাপের কারণে তাদের জন্য বিপুল পরিমাণ ওষুধেরও প্রয়োজন হয়। তাই কেউ কেউ বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
উৎসুক মানুষের ভিড়ে উদ্ধার কাজে বিড়ম্বনা
এদিকে অন্যান্য সময়ের মতো সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের পরও সেখানে উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বিনা প্রয়োজনে ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে ভিড় করায় উদ্ধার কাজে বেগ পেতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানে দায়িত্বরতরা।
চট্টগ্রাম হাসপাতালের সামনে দেখা গেছে, বিপুল পরিমাণ মানুষ অযথা ঘুরছেন। কেউ ছবি তুলছেন। কেউ আবার ফেসবুকে লাইভ করছেন।
একজনকে উচ্চস্বরে বলতে শোনা যায়, 'আরে ভাই মানুষ মারা যাচ্ছে আর আপনারা ছবি তোলায় ব্যস্ত।'
বিইউ/জেবি