লাশের পর লাশ। একে একে চল্লিশটি লাশ গোনা হলো। এরমধ্যেই ধীরে ধীরে দগ্ধ লাশগুলো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ইমার্জেন্সি কেয়ারের আজকের দৃশ্য এটি। চমেক যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে সীতাকুণ্ডের কনটেইনার বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধদের নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্সের হুইসেলে। কোনো কোনো অ্যাম্বুলেন্সে একটা, আবার কোনো কোনোটাতে দুটো করে লাশ নিয়ে ইমার্জেন্সি কেয়ারের বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছে। আবার সাইরেন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স নতুন কাউকে নিয়ে আসতে।
বিজ্ঞাপন
অ্যাম্বুলেন্স এলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন স্বজনরা। কেউ লাশ পেয়ে আহাজারি করছেন, আর কেউ লাশ না পেয়ে বুক ভাসাচ্ছেন। অন্যদিকে দৌড়ে এসে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে লাশঘরে ঢোকাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। তাদের চোখে পানি।
একেকজন ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, আনসারের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সেই রাত থেকে কতটা পরিশ্রম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তারা। সেই সাথে সকাল থেকেই আরও যুক্ত হয়েছেন সেনাবাহিনী, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও ডিবি পুলিশেরা।
এছাড়াও চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তিম বিভিন্ন সংগঠন ও এলাকা থেকে দগ্ধদের সেবায় ছুটে এসেছেন, কেউ কেউ আবার পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন ঔষধ ও অর্থসেবাও। তাদের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার, সন্ধানী, নিষ্ঠা ফাউন্ডেশন, আধ্যাত্মিক সংগঠন, মানবিক চট্টলা, উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ, গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ, ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ নাম জানা-অজানা অসংখ্য সংগঠন।
বিজ্ঞাপন
গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর পাচলাইশ থানা শাখার দায়িত্বশীল নেতা মুঈম দায়েমী বলেন, গতকাল রাত থেকেই আমাদের পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আমরা চট্টগ্রাম মহানগরের প্রায় সকল দায়িত্বশীলরা প্রথমে কনটেইনার বিস্ফোরণ ঘটনাস্থলে এবং পরে সিএমএইচ ও সিএমসিতে আহত ও নিহতের আনা-নেওয়াসহ প্রাথমিক খাদ্য সরবরাহ করছি।
তিনি আরও বলেন, দগ্ধদের মধ্যে যাদের স্বজনদের কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, আমরা দায়িত্ব নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং তাদের সকল প্রকার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।
এছাড়াও সকাল থেকেই স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেক, হাজী মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ ও আলী রহমান আইডিয়াল স্কুলসহ চট্টগ্রামের আরও পনেরো বিশটি কলেজের বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটসের সদস্যরা।
আলী রহমান আইডিয়াল স্কুলের একজন শিক্ষার্থী তামিম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা সেই সকাল থেকেই এখানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের সাথে চট্টগ্রামের আরো পনেরো বিশটি স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রোগী রোগীদের স্বজনদের চেয়ে সাধারণ মানুষ কয়েকগুণ বেশি। যাদেরকে থামিয়ে রাখা আমাদের জন্য কষ্টকর।
তিনি আরও বলেন, এরমধ্যেই লাশ দেখতে দেখতে একজন পুলিশ অফিসার অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তাকেও ভিতরে একটা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। জানি না, আগুনে পুড়া লাশ দেখতে দেখতে আমরাও না জানি কখন অজ্ঞান হয়ে যাই।
উল্লেখ্য, শনিবার (৪ জুন) রাত ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডের বিএম নামের একটি বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। প্রথমে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ একটি কনটেইনারে রাসায়নিক থাকায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। পরে রাসায়নিকের কন্টেইনারে একের পর এক বিকট বিস্ফোরণ ঘটতে থাকলে ঘটনাস্থল থেকে ২০/২৫ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে এবং কয়েক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত জানালার কাঁচগুলো ভেঙে যায়।
এই ঘটনায় সর্বশেষ তথ্যমতে, ৪৪ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ১ জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ও ৫ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী রয়েছে। এছাড়া প্রায় দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
আরএ/এইচই