বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘ভাইয়া আমি কি এখনো বেঁচে আছি’, দগ্ধ শরীফের বিস্ময়

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ০৯ জুন ২০২২, ১১:১৫ এএম

শেয়ার করুন:

‘ভাইয়া আমি কি এখনো বেঁচে আছি’, দগ্ধ শরীফের বিস্ময়

ঢাকা থেকে শিপমেন্টের মাল নিয়ে চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে মাল খালি করতে গিয়েছিলেন কাভার্ডভ্যান চালক শরীফ। সেখানে মাল খালি করার জন্য দুইদিন অবস্থান করেন। শেষ দিনে মাল খালি করে ঢাকায় ফিরবেন। এমন সময় আগুন লাগে। এ সময় তিনি তার বড় ভাই আরিফকে ফোন দেন। ঘটনার ১০ মিনিট আগে ভাইকে ফোনে বলেন, ভাই এখানে একটি কনটেইনারের আগুন লেগেছে। তখন তার ভাই পরামর্শ দেন যেন তিনি দূরে থাকেন। এরপর ২০ মিনিট পরে আবার ফোন দেন ভাইকে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে আওয়াজ আসে, ভাই আমাকে বাঁচা, আমার অবস্থা ভালো না। এখানে কন্টেইনার ব্লাস্ট হয়েছে। এ কথাই শেষ ছিল শরিফের। এরপর থেকে তার ফোনটি বন্ধ। এরপর দগ্ধ শরীফ তাকে আবিষ্কার করেন হাসপাতলে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে ভাই আরিফের সাথে দেখা হলে বলতে থাকেন, ‘ভাইয়া আমি কি এখনো বেঁচে আছি! ভাইয়া আমি যে এখানে আসবো কল্পনাও করিনি।’

সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে দগ্ধ শরিফ বর্তমানে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছে। বুধবার (৮ জুন) সকালে ভাই আরিফের সাথে হাসপাতালে কথা বলার এক পর্যায়ে নিজের বেঁচে থাকা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি। 


বিজ্ঞাপন


এরপর দগ্ধ শরিফ তার ভাইয়ের কাছে জানতে চায়, ‘ভাইয়া সবাই বেঁচে আছে তো, কি অবস্থা ডিপোর আগুনের। আগুন কি নিভছে?

একইদিন সন্ধ্যায় তার ভাই আরিফের সাথে কথা হচ্ছিল ঢাকা মেইলের এই প্রতিবেদকের। এ সময় কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন শরীফের ভাই আরিফ। 

আরিফ কান্না করতে করতে বলেন, কি করবো বলেন ভাইকে তো আর টেনশন দিতে পারি না। তার সাথে আমার ফুপাতো ভাই নোমান দগ্ধ হয়। এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ও একটু কম কিন্তু আমার ভাই বেশি দগ্ধ। ওরা দুজনেই খুব কাছাকাছি ছিল। শরিফ মুখ দিয়ে বেশি কথা বলতে পারছে না কারণ তার কথা আটকে যাচ্ছে। এখনো সে পুরোপুরি মুখ খুলতে পারেনি। শরিফের যে গাড়িটা নিয়ে গিয়েছিল সেটিও পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে তার আইডি কার্ড ও ড্রাইভিং লাইসেন্সও।

bune


বিজ্ঞাপন


তিনি জানান, সেই সময় শরীফ ডিপোর ভেতরে ছিল। শরিফের ফুপাতো ভাই নোমান গাড়িতে উঠে বসেছিল।  ওই সময় শরীফ গাড়ির নিচে ছিল। গাড়িতে ওঠার সময় পায়নি। সাথে সাথে কনটেইনার বিস্ফোরণ ঘটে এবং কেমিক্যালগুলো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। নোমান ও শরিফ বিস্ফোরণের পর দৌড়ানোর চেষ্টা করলে কেমিক্যালের ড্রামের উপরে পড়ে যান। ফলে তাদের পায়ে জখম হয়ে অনেক রক্তক্ষরণ হয়। পায়ের আঙ্গুলের মাথাগুলো আগুনে পুড়ে যায়।

খানিকবাদে নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো শুরু করলেন কথা। ভাইয়ের মুখের শেষ কথা শোনার পর কি করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না আরিফ। কারণ তখন তিনি ফেনীতে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের দূরত্ব কয়েক’শ কিলোমিটার। তার উপরে রাত গভীর হতে চলেছে। হঠাৎ এত রাতে কোথায় যাবেন কি করবেন চিন্তা রেখার ভাঁজ পড়ে গেল কপালে। 

এরপর তার কাছে থাকা ফোনটি আবার হাতে নিয়ে ভাইকে কল করতে শুরু করেন। কিন্তু ফোন কিছুতেই কেউ ধরছিল না। পরে হঠাৎ এক ব্যক্তি শরীফের ফোনটি ধরে জানান, তার ভাইকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। ওই লোক শুধু বলেন, তাকে জিসির মোড়ে নিয়ে যাচ্ছি। এরপর আরিফ বিষয়টি চট্টগ্রামে থাকা তার বড় ভাইকে জানান এবং সেখানে দ্রুত যেতে বলেন। তার ভাই চলে যান সোজা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখতে পারেন শরীফ মেঝেতে পড়ে আছে।  দ্রুত ভাইকে তুলে একটি ফোমের বেডে শুইয়ে দেন এবং ডাক্তার দেখে স্যালাইনের ব্যবস্থা করেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে বাস যোগে পৌঁছেন আরিফ। তিনি পৌঁছানোর পর মূল চিকিৎসা শুরু হয়। সেখানে একদিন থাকার পর শরীফকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় নিয়ে আসে সেনাবাহিনী।

arif

তার আগের ও সেই সময়ের মানসিক অবস্থার কথা বলছিলেন শরীফের বড় ভাই আরিফ। তাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর পূর্ব এজবালিয়া সোনাপুর গ্রামে। গ্রামে থাকে এক ভাই ও বাবা-মা। ভাইয়ের দুঃসংবাদ শুনে ওই রাতেই আর সেই বিষয়টি বাড়িতে জানাননি। কারণ বৃদ্ধ বাবা-মাকে জানালে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়বেন। 

শরীফের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোমর, চোখ ও ঠোঁট। তার দেহের বিভিন্ন জায়গায় কেমিক্যাল পড়ায় ফুলে গেছে। কোমরের অংশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এছাড়াও পা কেটে গেছে। হাত ও পায়ের আঙ্গুল পুড়ে গেছে। তেমনভাবে চোখ মেলাতেও পারছেন না। গত পাঁচ দিন থেকে কোন ভারী খাবার খেতে পারেনি শরীফ। ফলে থাকে তরল জাতীয় খাদ্য পাইপ দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে বলে জানালেন। 

আরিফ বলেন, এখন সে আগের থেকে একটু ভালো আছে। চোখে এখন ফোলা নেই। একটু একটু দেখতে পাচ্ছে। চোখের গ্যাস জমে থাকার কারণে আগে দেখতে পারেনি। চোখ অনেক ভুলে গিয়েছিল। ওর হাতের মধ্যে এখনো কেমিক্যাল লাগে আছে। কেমিক্যালগুলো দেখতে সাদা সাদা। ডাক্তার তার মুখ ও চোখ থেকে অনেক কেমিক্যাল বের করেছে। হাতের নখগুলোতে এখনও কেমিক্যাল ভেসে আছে। ও আমাকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলেছে এগুলো কেমিক্যাল। পরে আমি নার্স ডেকে কেমিক্যালগুলো পরিষ্কার ও ড্রেসিং করিয়েছি। 

বাবা হারুনও ছেলে আরিফের সাথে ছোট ছেলের দেখভালের জন্য গত পরশু থেকে হাসপাতালে রয়েছেন। আরিফ বলছিলেন, আমার ভাইয়ের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও আইডি কার্ড পুড়ে গেছে। এটা কোনো সমস্যা না, ভাই জীবিত ফিরে এসেছে এটাই অনেক। ভাই খাইতে চাইছিল, কিন্তু খাওয়াইতে পারি না। ভাই খাই নাই, আমি কি করে খাব! কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন দগ্ধ শরীফের ভাই আরিফ। শেষে দোয়া চাইলেন ভাইয়ের জন্য। 

এমআইকে/এএস

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর