মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

আদৌ কি ফেরত আসবে পাচারের টাকা?

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ১০ জুন ২০২২, ০৭:২০ পিএম

শেয়ার করুন:

আদৌ কি ফেরত আসবে পাচারের টাকা?
ছবি: ঢাকা মেইল

প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশে পাচার করা টাকা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে দেশে ফেরানোর সুযোগ দিচ্ছে সরকার। এই সুযোগে বেশ সাড়া পাওয়ার আশা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের। তবে মন্ত্রীর এমন চিন্তার উল্টো কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা সরকারের এমন সুযোগকে অনৈতিক বলছেন। পাশাপাশি পাচারের টাকা দেশে ফেরারও সম্ভাবনা সেই অর্থে নেই বলেও মনে করছেন তারা।

বিষয়টি নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এরই মধ্যে মন্তব্য করেছেন, ‘এই সুযোগ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে- বাংলাদেশে বসে অর্থ চুরি করে বিদেশে পাচার করা টাকা এখন সোনার চামচ দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া।’


বিজ্ঞাপন


গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিকেলে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপনকালে নির্ধারিত কর দিয়ে পাচার করা টাকা ফেরত আনার প্রস্তাব দেন।

বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিদেশে থাকা যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তি ১০ শতাংশ এবং নগদ টাকা আনতে চাইলে সাত শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করা যাবে।

Budget

এমন সুযোগ রাখার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রথমত- এটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দ্বিতীয়ত, অনৈতিক। এতে করে সৎ ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হবে। কারণ, তারা সরকারকে পাচার হওয়া টাকা ফেরতের অঙ্কের চেয়ে বেশি কর দেন।


বিজ্ঞাপন


তাদের কথায় আরও উঠে এসেছে, যে দেশ থেকে টাকা ফেরত আসবে সেখান থেকে আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়ে টাকা আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজন হবে। সর্বোপরি, পাচার করা টাকার মালিকরা তা ফেরত এনে নিজেরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে চাইবেন না। উল্টো, এমন সিদ্ধান্তে অসাধু লোকজন বিদেশে টাকা পাচারে উৎসাহিত হতে পারে বলেও আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

এদিকে, বাজেট নিয়ে আনুষ্ঠানিক এক প্রতিক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, এর দ্বারা করদাতারা নিরুৎসাহিত হবে। যারা টাকা বিদেশে পাচার করে, তারা দেশে ফেরত আনার জন্য করে না। ফলে এই সুবিধা দিলেও খুব বেশি টাকা ফেরত আসবে না।

অন্যদিকে, সরকারের এমন প্রস্তাবে সমর্থন নেই বলে জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম। বাজেট প্রস্তাবের পর তিনি বলেছেন, বিনা প্রশ্নে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়টা সমর্থন করি না। এতে টাকা পাচারের প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। যারা অসৎভাবে অর্থ উপার্জন করবে, তারা বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে দেবে।

বৈধ আয়ের লোকজন এমন সিদ্ধান্তে নিরুৎসাহিত হবে এমন মন্তব্য করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, যারা সৎভাবে কর দেয়, তাদের ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর পাচারকারীরা সাত শতাংশ কর দিয়ে অর্থ বৈধ করতে পারবে। এটা অনৈতিক। এতে যে খুব বেশি টাকা ফেরত আসে তাও কিন্তু নয়।

আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এমন প্রস্তাব সম্পূর্ণ অনৈতিক, অযৌক্তিক ও অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এমন সিদ্ধান্ত অর্থপাচারকে সুরক্ষা দেবে বলে মন্তব্য করে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী টাকা পাচারকারীদের জেল-জরিমানার বিধান আছে। সেখানে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে নামমাত্র করের বিনিময়ে বৈধতা দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এদিকে, পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরানোর সুযোগ দেওয়া হলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া দরকার করে বলে মনে করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

এই অর্থনীতিবিদ জানান, যে দেশে অবৈধভাবে অর্থপাচার করা হয়েছে, তারা (সরকার) চাইলেই ওই অর্থ ফেরত আনতে পারবে না। এটা আইনের প্রক্রিয়ার আওতায় দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার একটি বিষয়। ওই চুক্তি না থাকলে টাকা ফেরত আসবে না।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন এমন সুযোগেও টাকা ফেরত আনার সম্ভাবনা দেখছেন না বলে জানিয়েছেন।

বাজেট প্রস্তাবের পর সাবেক এই গভর্নর গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এটা কেমন সুযোগ বুঝতে পারছি না। একজন টাকা চুরি করে বিদেশে পাঠিয়েছে। এখন যতই সুযোগ হোক তিনি সেই টাকা ফেরত আনবেন- এমনটা মনে হয় না। কারণ, দেশের টাকা দেশে রাখলে টাকা পাচার করতেন না।’

এছাড়া পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেছেন, পাচার করা অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়াটা সম্পূর্ণ অবৈধ ও অসাংবিধানিক। এ কাজ সংবিধানের ২(৩) ধারার পরিপন্থী। এটা আসলে হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা মনে করেন, এটা সবার আগে নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য না। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘কালো টাকা সাদা করা বলেন, আর বিদেশ থেকে কর মওকুফ করে টাকা আনার আমি পক্ষে না। এটা নৈতিকতার বিচারে, অর্থনৈতিক সুবিধার দিক থেকে বলুন, কোনোভাবে এটা সমর্থনযোগ্য নয়।’

তবে বিভিন্নভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা দেশে ফেরত আনতে সরকারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শুক্রবার (১০ জুন) ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফেরত আনতে আপনারা বাধা দিয়েন না। বাধা দিয়ে আপনাদের কী লাভ? তারচেয়ে এই অর্থ দেশে ফেরত এলে তা উন্নয়নে ব্যবহার করা যাবে।’

মুস্তফা কামাল বলেন, ‘টাকার ধর্ম হচ্ছে, যেখানে রিটার্ন বেশি, সেখানে চলে যাওয়া। নানা কারণে দেশ থেকে টাকা চলে গিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এই টাকা ব্রিফকেসে করে কেউ নিয়ে যায়নি। হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে নিয়ে গেছে। তাই অনুমান করা গেলেও প্রমাণ করা যায় না। এ কারণে এসব অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব হয় না।’

Budget

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যমান বাস্তবতায় বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে এই টাকা জাতীয় অর্থনীতির স্রোতে এক হতে পারে।’

কালো টাকা সাদা করার বৈধতা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘টাকা ডিজিটাল মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ উন্নত দেশও এ ধরনের সুযোগ দেয়। নানা কারণে টাকা পাচার হয়, কোনো প্রমাণ ছাড়া এগুলোর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া যায় না। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে অ্যাকশনও নেওয়া হচ্ছে প্রমাণসাপেক্ষে। এগুলো আমরা চেষ্টা করছি ফেরত আনতে।’

উল্লেখ্য, গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এসব টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে।

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পাঁচ বছরে পাচারকারীরা তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। যার মধ্যে শুধু ২০১৫ সালেই দেশ থেকে পাচার হয়ে যায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় পাচারকারী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ।

বিইউ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর