শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘বাজেটে স্বস্তির জীবন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিতে হবে'

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ০৭ জুন ২০২২, ১০:০২ পিএম

শেয়ার করুন:

‘বাজেটে স্বস্তির জীবন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিতে হবে'
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ

মূল্যস্ফীতির চলমান পরিস্থিতি, করোনা পরবর্তি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং দরিদ্র জনসাধারণ যেন স্বস্তিমূলক জীবন নির্বাহের সুযোগ পান সেভাবেই ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট হওয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ। একইসঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়ানো, বিদেশি উৎসের বদলে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বড় ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। 

২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের প্রাক্কালে ঢাকা মেইলকে দেয়া সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেছেন ড. নাজনীন আহমেদ। সাক্ষাতকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বোরহান উদ্দিন


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল: বাজেটে কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত?
নাজনীন আহমেদ: প্রতিবছর সরকারের পক্ষ থেকে বাজেট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেটা কোন প্রেক্ষাপটে দেয়া হচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমরা জানি করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। অর্থাৎ আগামী একবছর আমাদের আয়-ব্যয়ের হিসেব যেটাই হোক, করোনায় যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে সেটা পুনরুদ্ধারের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে সামস্টিক অর্থনৈতিক বিষয় যেমন আছে, তেমনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন ছিল, বা যারা নতুন করে গরীব হয়েছে তাদের কথাও ভাবতে হবে। সামস্টিক অর্থনৈতিক বিচারে আমরা দেখেছি সারাবিশ্বেই মূল্যস্ফীতির যে গতি সেটার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতির সেই চাপ আরো বেড়েছে।

সেই প্রেক্ষিতে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ মানুষের কাছে তার জীবনযাত্রা একটা সহনীয় মাত্রায় বা মানসম্পন্ন জীবন যাত্রা অব্যাহত রাখতে মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু অতিরিক্ত উদ্যোগ লাগবে। 


বিজ্ঞাপন


ঢাকা মেইল: কোন ধরণের উদ্যোগের পরামর্শ দেবেন? 
নাজনীন আহমেদ: অনেক ধরণের পরামর্শ থাকবে। যেমন- আমাদের কৃষিতে ভর্তূকী অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে সারে ভর্তুকি দিতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়ে গেছে। সেটাকে সামাল দেয়ার জন্য যদি ভর্তুকি দেয়া হয় তাহলে কৃষক পর‌্যায়ে উৎপাদন খরচ বাড়বে না। এতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। এই মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের জন্য সেটা উপকারে আসবে।

এছাড়াও এই মুহূর্তে যেসব পণ্যের দাম বেশি আছে সেই জায়গাতেও কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকির প্রয়োজন হবে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল। এক্ষেত্রে সরকার কিছুটা কৌশলী হতে পারে। যেমন- অকটেন যেহেতু তুলনামূলক ধনী মানুষ ব্যবহার করে তাই এখানে ভর্তুকি না দিয়ে ডিজেলে ভর্তুকি দিলে ভালো হবে। কারণ এতে গণপরিবহণে চলাফেরা করা সাধারণ মানুষের চলাচলের খরচ বাড়বে না।

sociology

ঢাকা মেইল: সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কেমন হওয়া উচিত?
নাজনীন আহমেদ: অবশ্যই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের জন্য যে বরাদ্দ সেখানে চলমান অংশের পাশাপাশি আরো বেশি দেয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বেশি বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কোথাও কোথাও ব্যয় সংকোচন করতে হতে পারে। বিশেষ করে যে সকল প্রকল্প এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন না করলেও হয় তেমন প্রকল্প থেকে নিয়ে সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা যায়। তবে সেটা মেগা প্রকল্প থেকে নয়। কারণ মেগা প্রকল্প যেগুলোর কাজ শুরু হয়ে গেছে তার পেছনে অনেক বেশি ব্যয় হয়ে গেছে। এটা ধরে রাখার মানে হচ্ছে আরো খরচ বাড়বে।

আবার যেহেতু সার এবং জ্বালানির জন্য ভর্তুকি বাড়বে কাজেই সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্য তখন বরাদ্দের চাপ বাড়বে। সেই টাকাটা যেসব ছোট প্রকল্প আছে যা এখনই না করলেও হয় সেসব প্রকল্প থেকে এনে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে দেয়া যেতে পারে।

ঢাকা মেইল: দরিদ্র মানুষের জন্য কেমন কর্মসূচি নেয়ার পরামর্শ দেবেন?
নাজনীন আহমেদ: অবশ্যই সরকারের কর্মসৃজনমূলক যে বাজেট থাকে, স্বল্পকালীন কাজের জন্য যে বাজেট রাখা হয় সেই বাজেট থেকে নগর দরিদ্রদের জন্য প্রকল্প নিতে হবে। কারণ আমরা দেখেছি করোনার গ্রাম পর‌্যায়ের গরীবদের জন্য নানা কর্মসূচি থাকলেও নগরের দরিদ্রদের জন্য আসলে কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচির পরিমাণ কম। অথচ নগর দরিদ্র কিন্তু কম নয়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে তারাও কিন্তু কষ্টে আছে। তাই তাদের জন্য কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি নেয়া হলে সেখান থেকে তাদের আয় থাকবে।
badget symbolঢাকা মেইল: রাজস্ব আয় বাড়ানোর কৌশল কেমন হওয়া উচিত?
নাজনীন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘তফসিলি ব্যাংক পরিসংখ্যানে’ দেখেছি করোনার সময় কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। তাই যদি হয় তাহলে কিন্তু বুঝতে হবে কর দেয়ার মত মানুষও বেড়েছে। কারণ করোনায় সবার আয় কমেনি। বরং একটা জনগোষ্ঠীর আয় বেড়েছে। এর কারণও আছে। যেমন- নতুন নতুন অনলাইন কেনাকাটা বেড়েছে, কেউ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে আয় করেছে। অনেকে দ্রুত পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তাদের আয় বেড়েছে। অনেক বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান কিন্তু ২০২১ সালে আর বন্ধ রাখতে হয়নি। তাই এবছর রাজস্ব আদায়ের জন্য বড় ড্রাইভ দিতে হবে। আমাদের এত উন্নয়ন হচ্ছে সেটার সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হলে রাজস্ব আয়ের যে উপায়গুলো সেটা কাজে লাগাতে হবে। 

আমরা বারবার বলে থাকি যারা বাসা ভাড়া থেকে আয় করেন সেসব জায়গায় বিশেষ করে মফস্বলে আমরা কতটা ড্রাইভ দিয়েছি, আমাদের কাছে কি পরিমাণ ডাটা আছে? সেখানে আমাদের যেতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের আওতায় অনেক কিছু হয়েছে। আমি মনে করি এখানেও এমন উদ্যোগ নেয়া উচিত যেসব বাসা ভাড়ায় আছে সে তথ্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তাহলে কিন্তু বোঝা যাবে কোন এলাকায় কত বাসা ভাড়া হয়। একবার উদ্যোগ নিলেই কিন্তু এটা করা সম্ভব। revenueএই ধরণের কাজে এনবিআরের রাজস্ব বাড়াতে বিনিয়োগ করা উচিত। কিন্তু আগের যেসব পরামর্শ আছে যেমন- অটোমেশন, ইমপ্রুভমেন্ট, সেগুলোতে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের যেসব নতুন খাত সেখানেও কাজ করতে হবে।

এ বছর যেহেতু করোনা পরবর্তি পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ আছে তাই রাজস্ব আদায়ের দিকে নজর না দিলে বাজেট ঘাটতি বাড়তে পারে। তাই মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রেখে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সহনীয় রাখার কথা চিন্তা করে বাজেট পেশ করা হবে সেটাই সবাই প্রত্যাশা করে।

আমি মনে করি একবছরের আয় ব্যয়ের হিসেব, যে ধরণের কর্মসূচির আমরা চিন্তা করছি সেখানে করোনা থেকে উত্তরণের যে প্রক্রিয়া চলছে সেই চলমান প্রক্রিয়া যেন অব্যহত থাকে। এবং সাধারণ মানুষের দিকে যেন নজর দেয়া হয় এটাই হবে বাজেটের মূল্য লক্ষ্য।

taka

ঢাকা মেইল: আর্থিক সংস্কারের বিষয়ে অনেক কথা হয়। এ বিষয়ে কী বলবেন?
নাজনীন আহমেদ: দেখুন নতুন ভ্যাট আইন যখন করা হয় তখন থেকেই কিন্তু বলা হয়েছিল এটা দ্রুত বাস্তবায়নের কথা। সবশেষ ২০১৭ সালে এটি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করার থাকলেও সেটা আরো দুইবছর সময় নিয়ে বিভিন্ন বিষয় কাটছাট করে বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এরসঙ্গে অটোমেশনসহ যেসব বিষয় চালু হওয়ার কথা ছিল সেগুলো কিন্তু হয়নি। ভ্যাট আইনের সঙ্গে অনেক ধরণের ব্যবস্থা চালুর কথা ছিল সেটাও হয়নি। 

পাশাপাশি আয়করের ক্ষেত্রেও কিন্তু অটোমেশনের কথা বলা হয়েছিল। লোকবল বৃদ্ধির কথা ছিল। ঢাকাসহ বড় শহরের বাইরেও যেসব শহরে কর যারা আদায় করেন তাদের প্রশিক্ষণ, কর আদায়ের খাত বাড়ানো যেত। আসলে সংস্কারের যথেষ্ট প্রস্তাবনা আছে এগুলো অনেক আলোচনাও হয়েছে। আসলে এগুলো বাস্তবায়ন দরকার। বড় শহরের বাইরেও কর আদায়ের বিস্তার দরকার। এছাড়াও কর মেলা এটা সচেতনতার জন্য হলেও সব জায়গায় করা উচিত।

ঢাকা মেইল: বিদ্যমান অবস্থায় বিদেশি ঋণের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে মনে করেন?
নাজনীন আহমেদ: এবার যেহেতু আমরা রিজার্ভের উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাচ্ছি সেজন্য বিদেশি উৎস থেকে ঋণ না দেয়া ভালো। বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিলে হয়তো তাৎক্ষণিক বৈদেশিক লেনদেন বাড়বে। কিন্তু আমার এটা ফেরত দেয়ার চাপ থাকবে। আবার ফেরত দিতে হবে ডলারে সেটাও চিন্তা করতে হবে। 
rinএখন রিজার্ভ যেহেতু কিছুটা কমেছে  তাই এটা ধরে রাখতে চাচ্ছি, সে কারণে এ বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। বাজেটে তো ঘাটতি থাকবেই। সেহেতু বড় ঋণ লাগবে। সেই বড় ঋণ এবার বিদেশি উৎস থেকে না নেয়া ভালো। কারণ আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতি কোনদিকে যাবে, বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এটা তো জানি না কোথায় গিয়ে থামবে, সে কারণে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়া ভালো। অন্তত ডলারে ফেরত দিতে হবে না। 

আবার সঞ্চয়পত্রে যেহেতু অনেক বেশি সুদের হার তাই সেখান থেকে না নিয়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংক থেকে নেয়া যায়। সেক্ষেত্রে অবশ্য ব্যালেন্স করতে হবে। কারণ সরকার ঋণ নিলে বেসরকারি ঋণ পাবে না এমন কথাও বলা হয়। সেটা ব্যালেন্স করে ঋণ কিছুটা ভেতর থেকে কিছুটা বাইরে থেকে নেয়া যেতে পারে। 

সর্বোপরি মূল্যস্ফীতির চলমান পরিস্থিতি, করোনা পরবর্তি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে দরিদ্র জনসাধারণ স্বস্তিমূলক জীবন নির্বাহের সুযোগ পান সেভাবেই বাজেট হওয়া উচিত।

ঢাকা মেইল: সময় দেয়ার আপনাকে ধন্যবাদ
নাজনীন আহমেদ: ঢাকা মেইলকেও ধন্যবাদ

বিইউ/ একেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর