শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘বাজেট বুঝি না, পেট ভরে খাতি পারলেই খুশি’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮ জুন ২০২২, ১০:৫১ পিএম

শেয়ার করুন:

‘বাজেট বুঝি না, পেট ভরে খাতি পারলেই খুশি’
ছবি: ঢাকা মেইল

রাজধানীর বুকে রিকশা চালান সুরুজ মিয়া। আয় খুব একটা বাড়েনি। তবে কয়েক মাসে আগের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে। বাজারে পণ্যের দাম বেশি বলে খরচও বেশি হচ্ছে তার। প্রতি মাসে বাড়িতে আগের চেয়ে অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা দেওয়া লাগছে। এতে বাড়তি পরিশ্রম করেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।

বুধবার (৮ জুন) দুপুরের কড়া রোদে ঘেমে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন শুক্রাবাদে। আগামীকাল পেশ হতে যাওয়া বাজেট নিয়ে কোনো আগ্রহই নেই তার। উল্টো প্রশ্ন করেন- বাজারে জিনিসের দাম এত বাড়ে কেন? কমবো কবে? পাশে জড়ো হয়ে আড্ডা দেওয়া আরও কয়েকজনও যোগ দেয় আলোচনায়। জুলহাস উদ্দিন, কুড়িগ্রামে বাড়ি। গ্রামে গেলে আয় কমে যাবে, এই ভয়ে বাড়ি যাচ্ছেন না অনেক দিন।


বিজ্ঞাপন


বিগত কয়েক মাস ধরে একটু একটু করে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। দেশের মানুষ আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসেব মিলাতে হিমসিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেই নতুন বাজেট আসছে। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন বৃহস্পতিবার (৯ জুন)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী।

এবারের বাজেটের স্লোগান ‘কোভিডের বিপর্যয় জয় করে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা’। এটি আওয়ামী লীগের ২২তম ও স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১তম বাজেট। নতুন এই বাজেটের আকার চূড়ান্ত করা হয়েছে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেটটি উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে তাতে ঘাটতি থাকবে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। জিডিপির অংশ হিসেবে যা সাড়ে পাঁচ শতাংশ। বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ হলেও সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ।


বিজ্ঞাপন


সম্প্রতি বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেছে, হাতে তৈরি ও মেশিনজাত (নন-ব্র্যান্ড) পাউরুটি, বিস্কুট, কেকজাতীয় খাদ্যের দাম ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্য ২০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল বেকারি পণ্য প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ী সমিতি। কিন্তু বাজারে ২০ শতাংশের চেয়েও বেশি দামে এগুলো বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা দেখা যায়, ১০ টাকার পাউরুটি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। আর ১৫ টাকার রুটি পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ২০ টাকা এবং ৪০ টাকার রুটি ৪৫ টাকা করা হয়েছে। অথচ বেকারির এই রুটি অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ দুপুরে চায়ের সঙ্গে খেয়ে জীবন নির্বাহ করতো। বিশেষ করে রাজধানীর অনেক রিকশাওয়ালা-নির্মাণশ্রমিক দুপুরে ভাতের খাবার না খেয়ে খরচ বাঁচাতে চা-রুটি খেতো। মধ্যম আয়ের অনেক মানুষের নাস্তা হিসেবে থাকতো এই রুটি। তবে এখন দাম বাড়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।

নিম্নবিত্ত মানুষেরা বাজেট ও মূল্যস্ফীতির শব্দগুলোর সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত না হলেও বাজারের দামের সঙ্গে তাদের জীবিকা আয়-ব্যয় হিসেব করেন ভালোভাবেই। বলা হচ্ছে- বড় অঙ্কের এই বাজেটের অর্থের সিংহভাগ সামাজিক সুরক্ষামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি এবং উৎপাদনশীল নানা খাতে ভর্তুকি, প্রণোদনাসহ নগদ ঋণের সরবরাহ বৃদ্ধিতে খরচ করা হবে। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন- এবারের বাজেটের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়া।

Parliament

রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণির নিম্নআয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- তারা স্বস্তিতে থাকতে চান। এ জন্য বাড়তি ব্যয় তাদের কাছে মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ। তাই বাড়তি ব্যয় তারা চান না। কারওয়ান বাজারে সবজি নামানো শ্রমিক কুদ্দুস মিয়া বলেন, আগের আয়ে এখন আর বাজারে কিছু ধরা যায় না। বাজেট ভালা বুঝি না, সংসার যেন চালাতে পারি। বাচ্চাদের নিয়া একটু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারি, তাতেই খুশি।

সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) করা একটি জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে একজন মানুষের মাসিক খাবারের ব্যয় পাঁচ হাজার ৩৩৯ টাকা। চারজনের একটি পরিবারের ক্ষেত্রে এই খরচ হচ্ছে ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা। যদি কোনো পরিবার পুরো মাসে একবারও মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস ও মুরগি না খায়, তাহলেও খরচ আট হাজার ১০৬ টাকা। আর পুরো পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যয় ৪৭ হাজার ১৮২ টাকা। যেখানে গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে চলতি বছরে কেবল খাবারের ব্যয়ই বেড়েছে ১১ শতাংশ। এ জন্য বাজেটে সরকার যেন সামাজিক সুরক্ষা খাতে সর্বোচ্চ নজর দেয়- এমন প্রত্যাশা সবার।

অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রতিবছর সরকারের পক্ষ থেকে বাজেট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেটা কোন প্রেক্ষাপটে দেওয়া হচ্ছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা জানি- করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। অর্থাৎ আগামী এক বছর আমাদের আয়-ব্যয়ের হিসেব যেটাই হোক, করোনায় যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে সেটা পুনরুদ্ধারের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

বিভিন্ন উদ্যোগের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে সারে ভর্তুকি দিতে হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়ে গেছে। সেটাকে সামাল দেওয়ার জন্য যদি ভর্তুকি দেওয়া হয়, তাহলে কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন খরচ বাড়বে না। এতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। এই মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের জন্য সেটা উপকারে আসবে। এছাড়াও এই মুহূর্তে যেসব পণ্যের দাম বেশি আছে, সেই জায়গাতেও কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকির প্রয়োজন হবে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল।

এ ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা কৌশলী হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, যেমন- অকটেন যেহেতু তুলনামূলক ধনী মানুষ ব্যবহার করে তাই এখানে ভর্তুকি না দিয়ে ডিজেলে ভর্তুকি দিলে ভালো হবে। কারণ, এতে গণপরিবহণে চলাফেরা করা সাধারণ মানুষের চলাচলের খরচ বাড়বে না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের জন্য যে বরাদ্দ সেখানে চলমান অংশের পাশাপাশি আরও বেশি দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে।

দরিদ্র মানুষের জন্য কর্মসূচির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের কর্মসৃজনমূলক যে বাজেট থাকে, স্বল্পকালীন কাজের জন্য যে বাজেট রাখা হয়- সেই বাজেট থেকে নগরের দরিদ্রদের জন্য প্রকল্প নিতে হবে। কারণ, আমরা দেখেছি- করোনার গ্রাম পর্যায়ের গরিবদের জন্য নানা কর্মসূচি থাকলেও নগরের দরিদ্রদের জন্য আসলে কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচির পরিমাণ কম। অথচ, নগরে দরিদ্র কিন্তু কম নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তারাও কিন্তু কষ্টে আছে। তাই তাদের জন্য কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি নেওয়া হলে সেখান থেকে তাদের আয় থাকবে।

দেশে ধানের সব মৌসুমেই বাজারে চালের দাম কমে। কিন্তু এবার ভরা বোরো মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। এছাড়া বাজারে কোনো সবজি ৫০ টাকা কেজির নিচে নেই। শুধু খাদ্যপণ্য নয়, মানুষের প্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের দাম বাড়তি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে করে সাধারণ মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়েছে। আর নিম্নআয়ের মানুষের কাছে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার নামই জীবন। সরকার সেখানে বাজেটে কী সুখবর দেয়- সেটিই এখন দেখার বিষয়। যদিও সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা- এই বাজেটে জনসাধারণ যেন স্বস্তিমূলক জীবন নির্বাহের সুযোগ পান।

ডব্লিউএইচ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর