বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

হজ করার সময় শয়তানকে পাথর মারতে হয় কেন?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ জুন ২০২৩, ০৪:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

হজ করার সময় শয়তানকে পাথর মারতে হয় কেন?

হজের সময় শয়তানকে পাথর মারা ওয়াজিব। ইব্রাহিম (আ.) যখন শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করতে নিয়ে যাচ্ছিলেন, শয়তান কুমন্ত্রণা দিচ্ছিল যেন কোরবানি বাধাগ্রস্ত হয়। তখন ইব্রাহিম (আ.) তিন স্থানে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে বিতাড়ন করেছিলেন এবং আল্লাহর আদেশ পালনে সন্তানকে মাটিতে শায়িত করেছিলেন।

স্মৃতিবিজড়িত সেই ঘটনাকে চিরজাগ্রত রাখার জন্য কঙ্কর নিক্ষেপকে হজের বিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশনা পালন করতে এলে জামরা আকবার কাছে শয়তান তাঁর মুখোমুখি হয়। ইবরাহিম (আ.) সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন। সে জমিনে মিশে যায়। অতঃপর দ্বিতীয় জামরায় এলে তাকে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন। সে জমিনে মিশে যায়। অতঃপর তৃতীয় জামরায় এলে তাকে ফের সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন। সে জমিনে মিশে যায়। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তোমরা শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ কর। তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষ ইবরাহিম (আ.)-এর রীতিকে অনুসরণ করছ।’ (সহিহ আত তারগিব: ১১৫৬)


বিজ্ঞাপন


জামরায় পাথর নিক্ষেপ নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। তারা মনে করে যে তিন ‘জামরা’ হল তিন শয়তান কিংবা প্রত্যেক জামরার সাথে একটি করে শয়তান বাঁধা আছে। কিছু মানুষকে এমনও বলতে শোনা যায় যে, প্রথমটি হচ্ছে বড় শয়তান, পরেরটা মেঝ শয়তান, তারপরেরটা ছোট শয়তান। এ জাতীয় ধারণা সম্পর্কে আলেমরা বলেন, এসব কথা ইসলাম সমর্থন করে না। আসলে ‘জামরাত’ আরবি ‘জামরাতুন’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হচ্ছে ছোট ছোট কঙ্কর বা নুড়ি পাথর। যেহেতু এই সকল স্থানে ছোট ছোট কঙ্কর নিক্ষেপ করা হয় এজন্য এগুলোকে ‘জামরাত’ বলে।

আরও পড়ুন: যে কারণে সাফা-মারওয়া সায়ি করতে হয়

‘সংক্ষিপ্ত হজ, ওমরা ও জিয়ারত’ গ্রন্থে শায়খ আলী হাসান তৈয়ব (রহ) উল্লেখ করেন, ‘কঙ্কর নিক্ষেপের সময় ধীরস্থিরতা বজায় রাখা জরুরি, যাতে আল্লাহর নিদর্শনের অসম্মান না হয়। রাগ-আক্রোশ নিয়ে জুতো কিংবা বড় পাথর নিক্ষেপ করা কখনো উচিৎ নয়; বরং এটি মারাত্মক ভুল। জামরাতে শয়তান বাঁধা আছে বলে কেউ কেউ ধারণা করেন, তা ঠিক নয়। এ ধরনের কথার কোনো ভিত্তি নেই।’ (কঙ্কর নিক্ষেপের পদ্ধতি অংশ, পৃষ্ঠা-৮৫)

সুতরাং জামরায় পাথর নিক্ষেপ করতে হবে আল্লাহর ইবাদত হিসেবে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা মারওয়ার সাঈ ও জামরাতে কঙ্কর নিক্ষেপের বিধান আল্লাহর জিকির কায়েমের উদ্দেশেই করা হয়েছে।’ (তিরমিজি: ৯০২)


বিজ্ঞাপন


আরেকটি ভুল ধারণা হলো— জামরার স্তম্ভগুলোকেই পাথর মারতে হয়—এমন মনে করা। স্তম্ভগুলো ‘শয়তানের মূর্তি’ বা শয়তানের চিহ্ন নয় যে এগুলোকে পাথর মেরে ঘায়েল করতে হবে! বরং সেখানে ঘিরে রাখা বেসিনের মতো জায়গাটির মধ্যে পাথর মারলেই আমলটি পালন হয়ে যাবে। স্তম্ভগুলো শুধুমাত্র স্থানের নির্দেশক। কোনো মূর্তি না বা কোনো কিছুর প্রতীক না। পাথর নিক্ষেপের স্থানের স্তম্ভগুলো যদি ‘শয়তানের মূর্তি হত, তাহলে অন্য স্তম্ভগুলো কিসের ‘মূর্তি’ যেমন আরাফাতের স্তম্ভ বা হারাম এলাকা শুরুর স্তম্ভ ইত্যাদি?

সুতরাং যেকোনো ভুল ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, পবিত্র হারামাইনে কোনো পুতুল নেই, মূর্তি নেই, পৌত্তলিকতাও নেই। 

আরও পড়ুন: ‘মাকামে ইবরাহিম’ আল্লাহর কুদরতের অনন্য নিদর্শন

কঙ্কর নিক্ষেপের পদ্ধতি
হজযাত্রীদের ৯ জিলহজ হজের মূল বিধান আরাফাতের ময়দানে সারাদিন অবস্থান করে মুজদালিফায় যেতে হয়। রাতটা মুজদালিফার খোলা আকাশের নিচে ইবাদত ও জিকির করে কাটিয়ে ফজরের পর শয়তানকে মারার জন্য প্রত্যেক হাজিকে ছোট আকারের ২১টি পাথর সংগ্রহ করে মিনায় যেতে হয়। মিনায় গিয়ে তিনটি স্থানে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয়—১. জামারাতুল আকাবা (শেষ জামারা) ২. জামারাতুল উস্তা (মধ্যম জামারা) এবং ৩. জামারাতুল উলা (প্রথম জামারা)

জামারাতুল আকাবা মক্কার দিকে মসজিদুল খাইফের সর্ব নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত। একে জামারাতুল উখরা ও কুবরাও বলা হয়। ১০ জিলহজ এখানে তাকবির বলতে বলতে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করে তালবিয়া পাঠ বন্ধ করে দিতে হয়। কাবাঘর বাঁ দিকে ও মিনা ডান দিকে রেখে দাঁড়ানো সুন্নত। অন্য দুই জামারায় এদিন কঙ্কর নিক্ষেপ করতে নেই। ১১ তারিখে তিন জামারায় (প্রথমে ছোট, এরপর মধ্যম এবং সব শেষে বড় জামারায়) ৭–৩=২১টি পাথর মারতে হয়। ১২ তারিখেও অনুরূপ তিন শয়তানকে ২১টি পাথর মারতে হয়। তিন দিনে সর্বমোট ৭+২১+২১=৪৯টি কঙ্কর মারতে হয়।

কঙ্কর নিক্ষেপের সময়
সূর্যোদয়ের পর থেকে কঙ্কর নিক্ষেপের সময় শুরু হয়। তবে সুন্নত হলো সূর্য উঠার কিছু সময় পর দিনের আলোতে কঙ্কর নিক্ষেপ করা। জাবের (রা.) বলেন, ‘কোরবানির দিবসের প্রথম ভাগে (সূর্য উঠার কিছু পর) রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর উটের পিঠে আরোহণ অবস্থায় জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ করেছেন।’ (আবু দাউদ: ২/১৪৭)

সূর্য হেলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এর সময় থাকে। দুর্বল ও নারীদের জন্য ১০ তারিখের রাতে সূর্যোদয়ের আগে কঙ্কর নিক্ষেপের অবকাশ রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে যখন সহজে সুযোগ হয় তখনই কঙ্কর মারা যাবে।

কঙ্কর নিক্ষেপের ফজিলত
কঙ্কর নিক্ষেপের ফজিলত সম্পর্কে একাধিক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আর তোমার কঙ্কর নিক্ষেপ, তা তো তোমার জন্য সঞ্চিত করে রাখা হয়।’ (মুজাম কাবির: ১৩৩৯০)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আর জামারায় পাথর নিক্ষেপ, এক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নিচের বাণীটি প্রযোজ্য, ‘অতঃপর কোনো ব্যক্তি জানে না তাদের জন্য চোখ-জুড়ানো কী জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তারা যা করত, তার বিনিময়স্বরূপ।’ (সুরা: সাজদাহ: ১৭) (সহিহ আত তারগিব ওয়াত তারহিব: ১১১৩)

আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আর জামারায় তোমার কঙ্কর নিক্ষেপ, এতে তোমার নিক্ষিপ্ত প্রতিটি কঙ্করের বিনিময়ে একেকটি কবিরা গুনাহ মোচন করা হবে।’ (সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব: ১১১২)

রাসুলুল্লাহ (স.) আরো বলেন, ‘তুমি যদি কঙ্কর নিক্ষেপ করো, তোমার জন্য তা কিয়ামতের দিন নূর হবে।’ (সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব: ১৫৫৭)

আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক হজ ও ওমরাকারীকে ভুল ধারণা, অন্ধবিশ্বাস থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। সব আমল সুন্নাহ অনুযায়ী সম্পন্ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর