‘আমাদের দেশ থেকে অনেক বৃদ্ধ হজযাত্রী যায়। তাদের জন্য জেদ্দা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে ৪-৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকাটা কষ্টকর ছিল। ব্যাগ হ্যান্ডেল করাও কষ্টকর ছিল। কিন্তু এখন সেই কাজ মাত্র ৩০ সেকেন্ডে বাংলাদেশেই হয়ে যাচ্ছে। কোনোরকম পেরেশানি নেই। হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) তৎপরতায় এখন সৌদির ইমিগ্রেশন বাংলাদেশেই সম্পন্ন হচ্ছে। যা একটি যুগান্তকরী পদক্ষেপ।’ ঢাকা মেইলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলছিলেন হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম। এছাড়া হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেবার মান উন্নয়ন, সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়ও তুলে ধরেন তিনি। হাব সভাপতির এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা মেইলের স্টাফ রিপোর্টার তারিক আবেদীন ইমন।
ঢাকা মেইল: এই বছরের হজ পরিস্থিতি কি?
বিজ্ঞাপন
হাব সভাপতি: এ বছর এক লাখ ২২ হাজারের বেশি হজযাত্রী হজে গমন করবেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১০ হাজার দুইশ ৮৪ জন। বাকিরা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। ১ লাখ ২৭ হাজার ১৫৮ জনের কোটা ছিল। ১৩ জুন রাত পর্যন্ত ৭৯,০৪৪ জন হজযাত্রী সৌদি আরব গেছেন। যার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গেছেন ৯,৩৮৬ জন ও বেসরকারিভাবে ৬৯,৬৫৮ জন। হজ ব্যবস্থাপনায় কিছু চ্যালেঞ্জ বা কিছু ছোটখাট সমস্যা সবসময় থাকে। এক লাখ ২২ হাজার হজযাত্রী যাবে, এটা একটা বিশাল ব্যাপার- এর টোটাল ম্যানেজম্যান্ট, বাংলাদেশ পর্ব, সৌদি পর্ব। সঙ্গত কারণে ছোটখাট সমস্যা থাকতেই পারে। এগুলো সমাধান করে হজযাত্রীদের প্রেরণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এখন পর্যন্ত হজযাত্রীরা ভালোভাবেই যাচ্ছেন, তেমন বড় কোনো সমস্যা তৈরি হয় নাই। ছোটখাট যেসব সমস্যা হয়েছে সেগুলো আমরা সমাধান করেছি।
ঢাকা মেইল: হজযাত্রার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমস্যা হয়েছে কি না?
হাব সভাপতি: এ বছর একটা বড় সমস্যা ছিল। কিছু হজ এজেন্সির মালিককে ভুল বোঝাবুঝির কারণে সৌদিতে পুলিশ আটক করেছিল। তারা বেশি পরিমাণ টাকা অর্থাৎ সৌদির রিয়াল নিয়ে মুভ করছিলেন। তখন সৌদি পুলিশ সন্দেহ করে তাদের আটক করেছিল। পরে দেখা গেল যে টাকাগুলি বৈধ চ্যানেলেই নেওয়া। হজযাত্রীদের খাবারের খরচের জন্য তারা এই টাকা বহন করছিলেন। পুলিশ সেটা ইনকোয়ারি করে। এতে কারো কোনো দোষ না পেয়ে পুলিশ তাদেরকে ছেড়ে দেয়। টাকা সব ফেরৎ দিয়েছে। এজেন্সিগুলোর ৮২৩ জন হজযাত্রীকে নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ এখন সেই অনিশ্চয়তা আর নেই। আমরা তাদেরকে প্রেরণ করেছি। আজও (মঙ্গলবার) তাদের ২৮৬ জন হজে গেছে। মোট ৬৮৫ জন ইতিমধ্যে চলে গেছে। ১৩৮ জন বাকি আছে, তারা আগামীকাল যাওয়ার কথা। এছাড়া আর তেমন কোনো সমস্যা এ বছর নেই।
ঢাকা মেইল: এ বছর শুরু থেকেই বিমান ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে একটা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালতও কিছু মন্তব্য করেছিলেন। সেটার সর্বশেষ অবস্থা কি?
বিজ্ঞাপন
হাব সভাপতি: আমি বরাবরই বলে আসছি হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া বেশি ধরা হয়েছে। এটা আরও কমানোর সুযোগ ছিল। তাহলে হজের খরচ কিছুটা কমে আসত। আমি সবসময় বলি যে টেকনিক্যাল কমিটি দিয়ে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হোক। এতে বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে থাকবে এবং হজ সংশ্লিষ্ট বা হজযাত্রীদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি থাকে সেটার অবসান হবে।
ভবিষ্যতে যেন থার্ট পার্টি বা টেকনিক্যাল কমিটি দিয়ে বিমান ভাড়া নির্ধারণ হয়। হজযাত্রীদের জন্য যেটা ন্যায্য তারা সেটাই দেবে। এয়ারলাইন্সগুলোও প্রফিট করুক। অযৌক্তিকভাবে যেন ভাড়া বৃদ্ধি না হয়। এ বছর বহুবার আমি এই কথাগুলো উত্থাপন করেছি।
আর হাইকোর্টের যে বিষয়টা সেটা মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। বাস্তবায়ন করেছে কি না বা কিভাবে দেখছে তারাই ভালো জানে।
ঢাকা মেইল: প্রতি বছরই বেশকিছু এজেন্সি সম্পর্কে অভিযোগ পাওয়া যায়। কোরবানি বা দূরে হোটেল ভাড়া করা- এই জাতীয়। এবার সে ধরনের কোনো অভিযোগ আছে কি না?
হাব সভাপতি: হজযাত্রীদের জন্য প্যাকেজ নির্ধারণ করা আছে। প্যাকেজ অনুযায়ী হজযাত্রীদের সাথে এজেন্সিগুলোর চুক্তি হয়ে থাকে। সাধারণত প্যাকেজের সাথে কোরবানির বিষয়টা সংযুক্ত থাকে না। কোরবানির বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। এটা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা না। হজযাত্রীরা নিজের ইচ্ছামতো কোরবানি দেবেন। সেখানে কোরবানি দেওয়ার বহু প্রসেস আছে। সৌদি সরকার টাকা নিয়ে কোরবানির জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
এছাড়া হজযাত্রীদের বাড়িও চুক্তির মধ্যে থাকে। কত মিটারের মধ্যে হবে সেটাও নির্ধারণ করা থাকে। সেই অনুযায়ী প্যাকেজ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সেখানেই সেটা লেখা থাকে। আমি মনে করি, এগুলো হজযাত্রীরা নিজ দায়িত্বে বুঝে নেবেন। তারপরও যদি কোনো সমস্যা হয়, এজেন্সিগুলোর কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, আমরা তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসি। এটা সবসময় চলমান।
এ বছর এখন পর্যন্ত এ ধরনের গুরুতর কোনো অভিযোগ আসে নাই। যেমন- কারো ভিসা দেরি হচ্ছে, তাদেরকে হয়তো সজাগ করা হলো দ্রুত ভিসা করার জন্য, এ বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ইত্যাদি সমস্যাগুলোর অভিযোগ আমরা পাই। এখন পর্যন্ত বড় কোনো বিষয় কোনো এজেন্সির দ্বারা সংঘটিত হয় নাই। এখন পর্যন্ত ভালোভাবে চলছে।
ঢাকা মেইল: এ বছর হজযাত্রীদের বিশেষ কি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে?
হাব সভাপতি: সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে হজযাত্রীদের সৌদি আরবের ইমিগ্রেশন বাংলাদেশে হচ্ছে। এটা খুবই ভালো একটা বিষয়। হজযাত্রীদের এর আগে জেদ্দা বিমানবন্দরে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত হতো। এ বছর হজযাত্রীদের সৌদির ইমিগ্রেশন ঢাকাতেই হচ্ছে। ঢাকায় তারা আশকোনা হজ ক্যাম্পে আসবে। এখান থেকে চেকিং হয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ইমিগ্রেশন করবে। এরপর এয়ারপোর্টে যাবে। এয়াপোর্টের ১০ ও ১১ এলাকা সৌদি আরবের ইমিগ্রেশন এলাকা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ এটা করেছে। সুন্দরভাবে এটা পরিচালনা করা হচ্ছে। ওই এলাকায় গেলে মনে হবে এটা জেদ্দা এয়ারপোর্টেরই একটা অংশ। এটার অবয়ব, দৃশ্য, আর্কিটেকচারাল ডিজাইন সবকিছু সেই আদলেই করা হয়েছে। সেখানে কাজ করা ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা সৌদি আরব থেকে এসেছেন, তাদের ১৭০ জনের একটা টিম এখানে কাজ করছেন। এখানে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে একজনের ইমিগ্রেশন হয়ে যাচ্ছে। ১৫টা কাউন্টার করা হয়েছে।
ইমিগ্রেশন হওয়া পর হজযাত্রী সরাসরি ফ্লাইটে উঠেন। এই ফ্লাইট জেদ্দা বা মদিনায় ডমেস্টিক টার্মিনালে যায়। সেখান থেকে বাসে করে মক্কা বা মদিনায় নিয়ে যায়। তাদের ব্যাগগুলো ঢাকার আশকোনা হজ ক্যাম্প থেকে সৌদি কর্তৃপক্ষ রিসিভ করে নিজেরাই এয়ারপোর্ট হ্যান্ডেলিং করে সৌদিতে হজযাত্রীদের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
এটা একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমাদের দেশ থেকে অনেক বৃদ্ধ হজযাত্রী যায়। তাদের জন্য ইমিগ্রেশনে ৪-৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকাটা কষ্টকর ছিল। ব্যাগগুলো হ্যান্ডেল করাও তাদের জন্য কষ্টকর ছিল। এটার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকার, সৌদি কর্তৃপক্ষকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই প্রজেক্টটার নাম হচ্ছে ‘মক্কা রোড ইনিশিয়েটিভ’। এর সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত হাব।
ঢাকা মেইল: শোনা যায় অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে হজের খরচ তুলনামূলক বেশি। এ বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য কী?
হাব সভাপতি: হজের খরচ নির্ভর করে মূলত দুইটা অংশে। একটা বাংলাদেশ অংশ, আরেকটা সৌদি অংশ। সৌদি অংশের খরচ সৌদি কর্তৃক নির্ধারিত। এখানে তো আমাদের কিছু করার নাই। সেখানকার হোটেল ভাড়া, খাবার, মোয়াল্লেম ফি- এটা বিশ্বের সবার জন্য একই। আর বাংলাদেশের খরচ বলতে শুধু বিমান ভাড়া। সঙ্গত কারণে কমলে শুধু বিমান ভাড়াটাই কমতে পারে। অন্য কোনো খাতে কমানোর কোনো সুযোগ নাই।
আর প্যাকেজ মূল্য সারা বিশ্বেই বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণ, হজের সৌদি অংশের খরচ ডলার হয়ে রিয়ালে পরিশোধ করতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে সেটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর অন্যান্য দেশে যে কম খরচ বলা হয়, সেটা মূলত অনেক দেশেই সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। যার ফলে খরচ কমে আসে।
একটা জিনিস দেখেন, গত বছরই ১ ডলারের সেবার জন্য পরিশোধ করতে হয়েছে ৮৮-৯০ টাকা হিসেবে। এবার দেখেন সেই জায়গায় ১১২-১১৫ টাকা হিসেবে খরচ করতে হচ্ছে। এখানেই তো বেড়ে গেছে।
ঢাকা মেইল: আপনারা হাবের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কি ধরনের উন্নয়ন হয়েছে?
হাব সভাপতি: আমরা হাবের দায়িত্ব নেওয়া পর থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা ছিল। আগে অনেক হজযাত্রী হজে না যেতে পেরে প্রেসক্লাবে, বায়তুল মোকাররম, হজ ক্যাম্পের সামনে বিক্ষোভ করত, এহরামের কাপড় পরে অনশন করত। এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
আল্লাহর অশেষ রহমতে এগুলোর অবসান হয়েছে। আগে হজযাত্রীদের একটা করে ব্যাগ নিতে বাধ্য করা হতো। সেই ব্যাগগুলো ভেঙ্গে যেত, ব্যবহার করা যেত না। এই ধরনের আরও অনেক অনিয়ম ছিল। যা আমরা আসার পরে সমাধান করেছি। হজযাত্রী প্রতিস্থাপনের যে বিষয়টা ছিল, কেউ না গেলে তার জায়গায় অন্য কেউ যাওয়া- এটা আগে অনেক জটিল ছিল, আমরা সেটা সহজ করেছি। আরেকটা বিষয় ছিল, আগে হজযাত্রীদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স লাগত। এ জন্য শেষের দিকে অনেক হজযাত্রী হজে যেতে পারত না। আমাদের প্রচেষ্টায় হজযাত্রীদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়ম বাতিল করা হয়েছে।
তাছাড়া আগে হজের বিষয়টা ম্যানুয়াল ছিল। এখন সেটা হয় সম্পূর্ণ অনলাইনে। যা আগের থেকে অনেক সহজ হয়েছে। আগে রেজিস্ট্রেশনের ধারাবাহিকতা ছিল না। এখন সব কাজ হয় ধারাবাহিকভাবে। সৌদির ইমিগ্রেশনের কাজ ঢাকায় হচ্ছে। এই ধরনের অনেক কাজ যা আমাদের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে।
টিএই