বুধবার, ৮ মে, ২০২৪, ঢাকা

ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ 

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১ জুন ২০২৩, ০৮:৫৭ পিএম

শেয়ার করুন:

ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ 

ইহরাম বাঁধা হজ ও ওমরার অন্যতম ফরজ। মিকাত (নির্ধারিত স্থান) অতিক্রম করার আগে পুরুষদের দুইটি সেলাইবিহীন সাদা কাপড় এবং নারীদের নিজেদের স্বাভাবিক পোশাক পরে ইহরামের নিয়ত এবং তালবিয়া পাঠ করা জরুরি। এতেই ইহরাম সম্পন্ন হয়। ইহরাম অবস্থায় বেশ কিছু কাজ নিষিদ্ধ। এর মধ্যে কিছু নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য হারাম। কিছু শুধু পুরুষের জন্য হারাম। আর কিছু শুধু নারীদের জন্য হারাম বা নিষিদ্ধ। নিচে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজগুলো তুলে ধরা হলো।

পুরুষের জন্য হারাম 
সেলাই করা কাপড় পরা: পুরুষের জন্য শরীর বা কোনো অঙ্গের আকার অনুযায়ী তৈরিকৃত বা সেলাইকৃত কাপড় পরা নিষিদ্ধ। যেমন- পাঞ্জাবি, জুব্বা, শার্ট, সেলোয়ার, প্যান্ট, গেঞ্জি, কোট, সোয়েটার, জাঙ্গিয়া ইত্যাদি।


বিজ্ঞাপন


আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (স.)-কে জিজ্ঞাসা করল, মুহরিম (ইহরাম পরিহিত) কী কী কাপড় পরতে পারবে? তখন তিনি বলেন, জামা-পাগড়ি, পাজামা, টুপি ও মোজা পরবে না। তবে জুতা না থাকলে চামড়ার মোজা গিরার নিচ পর্যন্ত কেটে পরতে পারবে। তোমরা এমন কোনো কাপড় পরিধান করো না যাতে ‘জাফরান’ বা ‘ওয়ারছ’ লেগেছে।  (মুসলিম, খণ্ড: ০১, হাদিস: ৩৭২)

ইহরামের কাপড় ছিঁড়ে গেলে তা সেলাই করে কিংবা জোড়া দিয়ে পরা যাবে। তবে ইহরামের কাপড় এ ধরনের সেলাইমুক্ত হওয়াই ভালো। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪৮১; শরহু লুবাবিল মানাসিক: ৯৮)

ইহরাম অবস্থায় সেলাইযুক্ত ব্যাগ ব্যবহার করা ও বেল্ট বাঁধা নিষিদ্ধ নয়। তাবেয়ি উরওয়া (রহ.) মুহরিমের জন্য টাকা-পয়সা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রক্ষার উদ্দেশে ব্যাগ ব্যবহার করা বৈধ মনে করতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৫৬৯৯)

তাউস (রহ.) বলেন, মুহরিম কোমরবন্দ (বেল্ট) ব্যবহার করতে পারবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৫৬৮৯)


বিজ্ঞাপন


মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা: পুরুষের জন্য মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা নিষেধ। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, মুখমণ্ডল ও তার উপরের অংশ মাথার অন্তর্ভুক্ত। অতএব ইহরাম গ্রহণকারী থুতনি থেকে উপরের দিকে আবৃত করবে না। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৪৪৫২)

হাড় ঢেকে যায় এমন জুতা ব্যবহার: পুরুষের জন্য পায়ের পাতার উপরের উঁচু হাড় ঢেকে যায় এমন জুতা পরিধান করা নিষেধ। তাই এমন জুতা বা স্যান্ডেল পরতে হবে যা পরলে ওই উঁচু অংশ খোলা থাকে। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৯০)

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, তোমরা চাদর, লুঙ্গি ও চপ্পল পরে ইহরাম বাঁধবে। যদি চপ্পল না থাকে তবে চামড়ার মোজা গিরার নিচ পর্যন্ত কেটে পরিধান করবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৪৮৮১)

নারীদের জন্য হারাম
হাত মোজা পরা যাবে না। (সহিহ বুখারি: ১৭৪১)

মুখমণ্ডলের উপর নিকাব (ফাটল বিশিষ্ট পর্দা) পরবে না এবং সামনে কাছে কোনো অপর পুরুষ না থাকলে মুখমণ্ডলও আবৃত করবে না। (আবু দাউদ: ১৮৩৩; আলবাহরুর রায়েক: ২/২২৩; বাদায়ে ২/৪১০)

উকুন মারবে না বরং তা আলতোভাবে ধরে জমিনে রেখে দেবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৩২৯৭)

ঋতুমতী নারীরা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। (আবু দাউদ: ১/২৪৩)

নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য হারাম
সুগন্ধি ব্যবহার: ইহরাম অবস্থায় আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ। ইয়ালা ইবনে উমাইয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) যখন জিঈররানা নামক স্থানে অবতরণ করলেন, তখন এক ব্যক্তি তার কাছে এলেন, লোকটির পরনে জাফরান মিশ্রিত এক ধরনের সুগন্ধযুক্ত জুব্বা ছিল..। রাসুল (স.) তাকে বললেন, সুগন্ধির চিহ্ন দূর করো এবং জুব্বা খুলে ফেল।’ (মুসলিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা-৩৭৩)

সুগন্ধিযুক্ত তেল, জয়তুন, এমনকি তিলের তেলও লাগানো যাবে না। সুগন্ধি সাবান, পাউডার, স্নো, ক্রিম ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। বিখ্যাত তাবেয়ি আতা (রহ.) বলেন, ‘ইহরাম গ্রহণকারী তার শরীরে কিংবা কাপড়ে সুগন্ধিযুক্ত তেল লাগালে তার উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৪৮৩৩)

পৃথকভাবে সুগন্ধি জর্দা খাওয়াও নিষেধ। আর পানের সঙ্গে খাওয়া মাকরুহ। (মানাসিক: ১২১; আহকামে হজ: ৩৪)

বিখ্যাত তাবেয়ি কাসেম (রহ.) মুহরিমের জন্য খাবারের সঙ্গে সুগন্ধি জাফরান খাওয়া অপছন্দ করতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৩২৭৮)

নখ কাটা, চুল-পশম কাটা বা উপড়ানো: আতা, তাউস ও মুজাহিদ রাহ. প্রমুখ বিখ্যাত তাবেয়িগণ বলেন, ‘মুহরিম তার বগলের নিচের পশম উপড়ালে বা নখ কাটলে তার উপর ফিদিয়া দেওয়া ওয়াজিব হবে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৩৬০৪)

স্বামী-স্ত্রীর সহবাস: ইহরাম অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর জন্য সহবাস এবং এ সংক্রান্ত কোনো কথা ও কাজ করা নিষেধ। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হজের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ করার মনস্থির করে অতঃপর হজে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ।’ (সুরা বাকারা: ১৯৭)

এক ব্যক্তি তাওয়াফে জিয়ারতের পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়ে যায়। তাদের সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি একটি উট জবাই করার নির্দেশ দেন। (মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, পৃষ্ঠা-২৩৮)

যৌন কামনার সঙ্গে চুম্বন, স্পর্শ কিংবা জড়িয়ে ধরা: আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি ইহরাম অবস্থায় কামভাবের সঙ্গে নিজ স্ত্রীকে চুম্বন করেছি। এখন আমার করণীয় কী? তিনি উত্তরে বললেন, তুমি একটি কোরবানি করো। (কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মাদ, পৃষ্ঠা নং-৫৩)

পশু শিকার: ইহরাম অবস্থায় বন্য পশু শিকার বা শিকারিকে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ।  আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের ওপর  প্রাণী শিকার করা হারাম করা হয়েছে, যে পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাক। (সুরা মায়েদা: ৯৬)

জাবির (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, ইহরাম অবস্থায় স্থলভাগের শিকারকৃত প্রাণী তোমাদের জন্য হালাল, যদি তা তোমরা নিজেরা শিকার না করো কিংবা তোমাদের উদ্দেশ্যে শিকার করা না হয়। (তিরমিজি, খণ্ড: ১, হাদিস: ১৭৩)

মাথার চুল মুণ্ডন করা বা ছোট করা কিংবা উঠিয়ে ফেলা: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর কোরবানি যথাস্থানে না পৌঁছা পর্যন্ত নিজেদের মস্তক মুণ্ডন করো না। আলেমরা, শরীরের সব চুলকে মাথার চুলের ওপর কেয়াস করেছেন। তাই ইহরাম অবস্থায় থাকা ব্যক্তির জন্য শরীরের কোনো চুল দূর করা জায়েজ নয়।

ঝগড়া-বিবাদ (সাধারণ সময়েও নিষিদ্ধ): ইহরাম অবস্থায় ঝগড়া-বিবাদ আরো মারাত্মক। কোরআন কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হজের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ করা স্থির করে, অতঃপর হজে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ।’ (সুরা বাকারা: ১৯৭)

জাবির ইবনে যায়েদ (রহ.) আল্লাহ তাআলার বাণী ‘এবং না ঝগড়া-বিবাদ’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তোমার জন্য এই অবকাশ নেই যে, সঙ্গীর সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং তাকে রাগান্বিত করবে।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৩৩৯৪)

ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ তাতে লিপ্ত হওয়া গুনাহ। এর কারণে হজ অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। উপরন্তু কিছু বিষয় এমন রয়েছে যাতে লিপ্ত হলে ‘দম’ ওয়াজিব হয়। ইবরাহিম নাখাঈ (রহ.) বলেন, বলা হত, যে ব্যক্তি হজে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করলো, সে এর জন্য একটি পশু জবাই করবে।’ মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ১৫১৯১)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজের যাবতীয় হুকুম-আহকাম মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর