ভারতের কেরালা রাজ্যের শিহাব চত্তুর নামের এক যুবক গত ২ জুন হজের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করেছেন। ২০২৩ সালের হজে অংশ নিতে কোনো যানবাহনে আরোহন ছাড়াই পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছার আশা তাঁর। ফজরের নামাজ শেষে হাঁটা শুরু করেন রাজ্যের মালাপ্পুরাম জেলার আথাভানাদ এলাকার এই বাসিন্দা। ২৮০ দিনে ৮৬৪০ কি.মি পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁকে। এজন্য প্রতিদিন হাঁটতে হবে ২৫ কি.মি পথ।
জানা যায়, পাঞ্জাবের ওয়াগাহ বর্ডার পার হয়ে পাকিস্তানে পৌঁছবেন তিনি। এরপর ইরান, ইরাক, কুয়েত পাড়ি দিয়ে সৌদি আরবে পৌঁছবেন। রাতযাপন করবেন দেশগুলোর বিভিন্ন মসজিদে। দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিতে শিহাব সঙ্গে নিয়েছেন একটি ছাতা এবং ১০ কেজি ওজনের একটি ব্যাগ। যাতে রয়েছে কয়েকটি টি-শার্ট, ট্রাউজার, বিছানার চাদর ও সামান্য কিছু খাবার।
বিজ্ঞাপন
গণমাধ্যমকে শিহাব বলেন, ‘আমি হেঁটে মক্কায় যাওয়ার ইচ্ছা করেছি এবং প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছি। প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। আমি একজন সুস্থ মানুষ এবং দিনে ২৫ কিলোমিটার হাঁটতে পারি। সুতরাং আমার হজযাত্রা শুরু করা আবশ্যক।’
এদিকে আট মাস আগে থেকেই শিহাবের প্রস্তুতি শুরু হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হজযাত্রার জন্য আমার ভ্রমণ বিমার প্রয়োজন ছিল, যেন পথে কোনও দুর্ঘটনার শিকার হলে আর্থিক সাহায্য পাই। পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত ও সৌদি আরবের ভিসার প্রয়োজন ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি মুরালিধরন আমাকে প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছেন।’

এই প্রেক্ষাপটে শিহাবের পায়ে হেঁটে হজে যাওয়ার বিষয়টিকে ইসলাম কীভাবে দেখে? ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এতে দোষের কিছু নেই, বরং বায়তুল্লাহ জিয়ারতের নেক উদ্দেশ্য নিয়ে এমন কাজ অনেক সওয়াবের। এতে কোনো আলেমের দ্বিমত নেই। উপরন্তু, হাদিসের ভাষ্যমতে, মসজিদে যাওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপেই সওয়াব। জাবের বিন আবদিল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, মসজিদে নববির আশপাশে কিছু জায়গা খালি হলো। এটা দেখে বনু সালামা মসজিদে নববির কাছে স্থানান্তরিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
বিজ্ঞাপন
এ খবর রাসুলুল্লাহ (স.) জানতে পারলে তিনি তাদের বলেন, আমি জানতে পেরেছি- তোমরা মসজিদের কাছে চলে আসার ইচ্ছা করছ! তারা বলল, জি হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা এমনটা ইচ্ছা করেছি। তিনি বলেন, ‘হে বনু সালামা, তোমরা তোমাদের বাড়িতেই থাকো। কেননা এতে (দূরত্বের কারণে) মসজিদে আসতে তোমাদের পদক্ষেপ বৃদ্ধি পাবে এবং তোমাদের পদচিহ্ন (তোমাদের আমলনামায়) লিখিত হবে....। (সহিহ মুসলিম: ৬৬৫)
শুধু তাই নয়, ‘..যে ব্যক্তি জামাতে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদের দিকে অগ্রসর হন, তিনি আল্লাহর জিম্মায় চলে যান। এ অবস্থায় তিনি যদি মারা যান, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করেন..’ (আদাবুল মুফরাদ: ১০৯৪)।
দূর-দুরান্ত থেকে বাইতুল্লায় যাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা—‘আর মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে’ (সুরা হজ: ২৭)। এখানে পায়ে হেঁটে হজের কথা বলা হয়েছে। তাই আলেমদের মতে, কেউ যদি প্রশাসনিক সব বিষয় সমাধান করে পায়ে হেঁটে হজে যেতে পারেন বা যেতে চান, তাহলে তিনি যাবেন। এজন্য ওই ব্যক্তিকে নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
উপরোক্ত আয়াতে বাহন ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। আবার বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, বাহন ব্যবহার করার বিকল্পও নেই। তবে কেউ স্থলপথে মক্কায় যাওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অনুমতি পেলে এবং অতদূর হাঁটার সামর্থ্য থাকলে হেঁটে যাওয়াতে সমস্যা নেই। সেটা তো আর সবার পক্ষে সম্ভব হওয়ার কথা নয়। তাই ফতোয়া হচ্ছে—আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য না থাকলে তার জন্য হজ ফরজ নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ।’ (সুরা আলে ইমরান: ৯৭)। পায়ে হেঁটে হজযাত্রা বর্তমান সময়ে নিরাপদ নয়, তাই বাহনের খরচও সামর্থ্যবান হওয়ার শর্ত। কেননা আল্লাহ তাআলা বান্দার ওপর অসাধ্য বোঝা চাপিয়ে দেন না। তিনি খুব ভালো করে জানেন কার সাধ্য কতখানি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না, সে তাই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তাই তার ওপর বর্তায় যা সে করে।’ (সুরা বাকারা: ২৮৬)
তবে রিয়া বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ এমন নেক আমল করলে এর পরিণাম হবে অনেক ভয়াবহ। সুতরাং কেউ যদি নিজের নামডাক চারদিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড-এ নাম লেখানোর জন্য, অথবা সহজ ভাষায় ‘ভাইরাল’ হওয়ার জন্য পায়ে হেঁটে হজ করার জন্য রওনা দেন, তাহলে এই বিষয়টিকে ইসলাম সমর্থন করে না। মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করে তাকে জাহান্নামি বানানোর জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ এই ‘রিয়া’। মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন—
‘আমি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, তা হলো শিরকে আসগর (ছোট শিরক)। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! শিরকে আসগর কী? তিনি বলেন, রিয়া বা লোক দেখানো আমল। কেয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে তাদের কাছে যাও, দেখো তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’ (আহমদ, আল-মুসনাদ: ৫/৪২৮-৪২৯; হাইসামি, মাজমাউজ জাওয়াইদ: ১/১০২, মান- সহিহ)
প্রসঙ্গত, ‘স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলে তার ওপর হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম: ২/১৫২; আহসানুল ফতোয়া: ৪/৫১৬)
একইভাবে ব্যবসায়ীর দোকানে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তার কিছু অংশ বিক্রি করলে যদি হজ করা সম্ভব হয় এবং ফিরে এসে যদি বাকি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম: ২/১৫৩)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজের যাবতীয় মাসায়েল জানার ও বুঝার তাওফিক দান করুন। বায়তুল্লাহ জেয়ারতের সুপ্ত ইচ্ছা ও স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দিন। আমিন।























































































































