রোববার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

কাবা তাওয়াফের নিয়ম ও দোয়া

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৬ জুন ২০২৩, ১০:০২ এএম

শেয়ার করুন:

কাবা তাওয়াফের নিয়ম ও দোয়া

কোনো কিছুর চারদিকে প্রদক্ষিণ করাকে শাব্দিক অর্থে তাওয়াফ বলে। হজের ক্ষেত্রে কাবা শরিফের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পবিত্র কাবা তাওয়াফ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন—সুরা হজের এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে এবং তাদের মানত পূর্ণ করে ও তাওয়াফ করে প্রাচীন গৃহের (কাবাঘরের)।’ (সুরা হজ: ২৯)

হজের গুরুত্বপূর্ণ রোকন তাওয়াফ। হজের নির্দিষ্ট ৫ দিনসহ হাজিগণ দীর্ঘ দিন মক্কায় অবস্থান করেন। এ সময়ে প্রতিনিয়ত তাঁরা তাওয়াফ করবেন। তাওয়াফের অনেক ফজিলত রয়েছে। সে কারণেই তাওয়াফ যেন সঠিক এবং সহিহ হয়ে সে জন্য তাওয়াফের নিয়ম-কানুন জানা জরুরি। এখানে ধারাবাহিকভাবে পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফ করার পদ্ধতি তুলে ধরা হলো- বায়তুল্লাহ তাওয়াফ


বিজ্ঞাপন


তাওয়াফ শুরু স্থান
পবিত্র কাবা শরিফের যে কোনায় হাজরে আসওয়াদ স্থাপিত, সেই কোনা থেকে মাতাফের (তাওয়াফের জায়গার) ওপর দিয়ে মসজিদে হারামের দিকে একটা দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া আছে এবং কাবা শরিফের গিলাফের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আরবিতে ‘আল্লাহু আকবর’ শব্দের ক্যালিগ্রাফি খচিত লেখা রয়েছে। সে বরাবর দাগের ওপর দাঁড়ানো। কাবা শরিফ তাওয়াফ

হাজরে আসওয়াদ চুম্বন ও চক্কর
তাওয়াফ শুরু করার আগে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা অথবা স্পর্শ করা; সম্ভব না হলে দাগের ওপর দাঁড়িয়ে চলা শুরু করার সময় নামাজের নিয়ত বাঁধার মতো করে উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠিয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে মুখে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর` বলে চক্কর দেয়া শুরু করা।

যেদিকে যাবে
হাজরে আসওয়াদ থেকে পবিত্র কাবা শরিফের দরজার দিকে অগ্রসর হওয়া। এর পর হাতিমে কাবা বাহিরে দিয়ে রুকনে শামি ও ইরাকি অতিক্রম করে রুকনে ইয়ামেনি বরাবর এসে তা স্পর্শ করা। যদি সম্ভব না হয়ে তবে হাতে ইশারা করা। রুকনে ইয়ামেনি থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত আসতে এই দোয়া পড়া-‘রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনইয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানাতাও ওয়া ক্বিনা আ’জাবান নার।’ অর্থাৎ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়া এবং পরকালের কল্যাণ দান করুন এবং জাহান্নামের আগুণ থেকে মুক্তি দান করুন।’

হাজরে আসওয়াদের কোনায় এসে আগের মতো আবারো স্পর্শ বা ইশারার মাধ্যমে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে চক্কর শুরু করা। এভাবে সাত চক্করের মাধ্যমে তাওয়াফ সম্পন্ন করা। তাওয়াফ করার নিয়ম


বিজ্ঞাপন


তাওয়াফ আদায়কালে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে-
ইজতিবা করা: যারা ইহরাম বেঁধে হজ ও ওমরার জন্য ফরজ তাওয়াফ করবেন, তাঁদেরকে তাওয়াফের সময় অবশ্যই ইজতিবা করতে হবে। আর তাহলো বীর-বাহাদুরিসূলভ চাদর পরিধান করা। চাদরের মধ্যভাগ থাকবে ডান বগলের নিচে। আর ফরজ তাওয়াফ না হলে সাধারণ তাওয়াফের বেলায় যে কোনো পোশাকেই তাওয়াফ করা যাবে। কাবা তাওয়াফ ফজিলত

হাতিমে কাবাসহ তাওয়াফ: রোকনে শামি ও রোকনে ইরাকির মধ্যে অবস্থিত অর্ধবৃত্তাকার অংশটিকে হাতিমে কাবা বলা হয়। বায়তুল্লাহ তাওয়াফকালে হাতিমে কাবাকেও প্রদক্ষিণ করা।

হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু এবং শেষ: তাওয়াফ হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু হয়ে মুলতাজেম, কাবা শরিফের দরজা, হাতিমে কাবা হয়ে রুকনে শামি ও ইরাকি শেষ করে রুকনে ইয়েমেনি অতিক্রম করে আবার হাজরে আসওয়াদে এসে শেষ করা। বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ করার সময় রুকনে ইয়েমেনি কর্নার অতিক্রমকালে সম্ভব হলে চুম্বন করা বা হাতে স্পর্শ করা। ভিড় থাকলে ইশারা করাই যথেষ্ট।

রমল করা: বায়তুল্লাহকে সাতবার চক্করের মাধ্যমে তাওয়াফ শেষ হয়। এ সাত চক্করের প্রথম তিন চক্করে রমল করতে হবে। প্রথম তিন চক্বরকে রমল বলে। অর্থাৎ বীর দর্পে দ্রুততার সঙ্গে তাওয়াফ করা। পরবর্তী চার চক্কর স্বাভাবিকভাবে হেটে তাওয়াফ সম্পন্ন করা।

বায়তুল্লাহ তাওয়াফের দোয়া
কাবা শরিফ তাওয়াফের সময় আল্লাহ তায়ালার জিকির করতে হয় এবং মনে মনে দোয়া করতে হয়। তবে এ সময়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নবীজি (স.) থেকে বর্ণিত হয়নি। তবে রুকনে ইয়ামেনি ও হাজারে আসওয়াদের মাঝে নিচের দোয়াটি পড়তেন বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। দোয়াটি হলো- رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ উচ্চারণ: ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াকিনা আজাবান্নার।’ অর্থ: ‘হে আমার প্রভু! আমাকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান কর, আখেরাতেও কল্যাণ দান কর এবং আমাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও ‘ (সুরা বাকারা ২০১, মুসনাদে আহমদ: ৩/৪১১), সহিহ ইবনে হিব্বান: ৯/১৩৪), মুস্তাদরাকে হাকেম: ১/৬২৫)

এছাড়া হাজরে আসওয়াদ অতিক্রমের সময় তাকরিব দিতেন নবীজি (স.)। (সহিহ বুখারি: ৪৯৮৭)

এর বাইরে তাওয়াফের সময় যেকোনও জিকির, দোয়া ও কোরআনের ফজিলতপূর্ণ আয়াত তেলাওয়াত করা যাবে। ইবনে কুদামা বলেন, ‘তাওয়াফের মধ্যে দোয়া করা, বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা মুস্তাহাব। কারণ, জিকির করা সবসময় মুস্তাহাব। আর এই ইবাদত পালনকালে তা আরও বেশি উত্তম। এ সময় আল্লাহর জিকির কিংবা কোরআন তেলাওয়াত কিংবা সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ অথবা যা না হলে নয় এমন কিছু ছাড়া অন্য কোন কথাবার্তা না-বলা মোস্তাহাব। (আল-মুগনি: ৩/১৮৭) 

আলেমরা বলেন, তাওয়াফকারী দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য যেকোনও দোয়া যেমন, সুবহানাল্লাহ বলা, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে পারবে। (মাজমুউল ফতোয়া: ২৪/৩২৭)

কাবা তাওয়াফের ফজিলত
কাবা তাওয়াফের ফজিলত সম্পর্কে ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, বায়তুল্লাহর চারদিকে তাওয়াফ করা নামাজ আদায়ের অনুরূপ। তবে তোমরা এতে (তাওয়াফকালে) কথা বলতে পারো। সুতরাং তাওয়াফকালে যে ব্যক্তি কথা বলে সে যেন ভালো কথা বলে। (তিরমিজি: ৯৬০)

তাওয়াফের জন্য যেসব কাজ ওয়াজিব
১. শরীর পবিত্র রাখা, অজু করা। নারীদের জন্য ঋতুস্রাব অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েজ নেই।
২. সতর ঢাকা। অর্থাৎ যেটুকু ঢাকা প্রত্যেক পুরুষ-নারীর জন্য ফরজ।
৩. ‘হাতিমে কা’বার’ বাইরে থেকে তাওয়াফ করা।
৪. হেঁটে তাওয়াফ করা। অক্ষম ব্যক্তি খাটিয়ার মাধ্যমে তাওয়াফ করতে পারেন।
৫. ‘হাজরে আসওয়াদ’ থেকে শুরু করে ডানদিক দিয়ে তাওয়াফ শুরু করা।
৬. এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে ‘সাতবার চক্কর’ দিয়ে তাওয়াফ পূর্ণ করা।
৭. ‘সাত চক্করে’ এক তাওয়াফ; এটা পূর্ণ হলেই ‘তাওয়াফের’ নামাজ পড়া।

তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী
১. তাওয়াফের শুরুতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ এর দিকে মুখ করা।
২. সম্ভব হলে ‘হাজরে আসওয়াদ’ চুম্বন করা। নতুবা হাত দিয়ে দূর থেকে ইশারা করা। আর মুখে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ বলা।
৩. হাজের আসওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে তাকবিরে তাহরিমা’র মতো উভয় হাত সিনা পর্যন্ত তোলা।
৪. যে তাওয়াফের পরে ‘সায়ি’ আছে, তাতে ‘ইজতেবা’ করা। অর্থাৎ ইহরামের চাদরের (উপরের অংশের) দুই মাথা ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের ওপর ফেলে দেওয়া।
৫. ‘সাঈ’-যুক্ত ‘তাওয়াফে’র প্রথম তিন চক্করে ‘রমল’ করা। ওঠাত বীরের মতো হেলে দুলে জোর কদমে (একের পর এক পা ফেলে) চলা।
৬. বাকি চার চক্কর সাধারণ গতিতে (ধীরে ধীরে) সম্পন্ন করা।
৭. প্রত্যেক চক্কর তাওয়াফ শেষ করে এবং শেষ চক্করেরও পরে ‘হাজের আসওয়াদ’কে চুম্বন করা। সম্ভব না হলে দূর থেকে ইশারা করে- ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহ আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ দোয়াটি পাঠ করা এবং ৩ নম্বর নিয়মের মতো দাঁড়িয়ে ইশারা করে ‘তাওয়াফ’ শেষ করা।

তাওয়াফের নিয়ত
নিয়ত আসলে মুখে পড়তে হয় না, বরং করতে হয়। হাদিসে ও ফিকহের কিতাবগুলোতে সর্বক্ষেত্রে নিয়ত করার কথা বলা হয়েছে। মনে মনে ইচ্ছে পোষণ করাকে নিয়ত বলে। তবে কেউ এরপর পড়তে চাইলে পড়তে পারেন। তবে নিয়ত করার চেয়ে পড়াকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ মনে করা যাবে না। কেউ চাইলে পড়তে পারেন এভাবে— ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদু তাওয়াফা বাইতিকাল হারাম ফায়াসসিরহু-লি, ওয়া তাক্বাব্বাল-হু-মিন্নি, সাবাআ’তা আশওয়াাতিন লিল্লাহি তাআলা।’ অথবা বাংলায় এভাবে বলতে পারেন: ‘হে আল্লাহ আমি তাওয়াফ পালনের জন্য নিয়ত করলাম।’

তাওয়াফের শর্ত
তাওয়াফের জন্য ৬টি শর্ত রয়েছে। এগুলো মধ্যে ৩টি শর্ত সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। আর ৩টি শর্ত শুধুমাত্র হজের ফরজ রুকন তাওয়াফে জিয়ারতের জন্যই প্রযোজ্য।

সর্বাবস্থায় পালনীয় ৩ শর্ত হলো—১) মুসলমান হতে হবে। ২) তাওয়াফের নিয়ত অর্থাৎ তাওয়াফের ইরাদা বা ইচ্ছা থাকতে হবে। ৩) তাওয়াফ মসজিদে হারামের মধ্যে হতে হবে।

হজের জন্য পালনীয় ৩ শর্ত হলো— ১) তাওয়াফে জিয়ারত নির্দিষ্ট সময়ে হওয়া। আর তা হলো ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত। ২) তাওয়াফ ইহরামের পরে হওয়া। ৩) আর উকুফে আরাফা অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের পরে হওয়া (৯ জিলহজ)

পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফ হজ ও ওমরার জন্য ফরজ কাজ। হজ ও ওমরাকে সঠিক ও পরিপূর্ণ করতে হলে পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফ করা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুন্দরভাবে নবীজির অনুসরণে পবিত্র কাবা শরিফকে সহিহভাবে তাওয়াফ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর