পবিত্র মসজিদে নববি। সৌদি আরবের মদিনা মুনাওয়ারায় এর অবস্থান। রাসুল (স.)-এর পবিত্র রওজা সংযুক্ত এই মসজিদকে কেন্দ্র করেই ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিলো। হিজরতের পর রাসুল (স.)-এর নিজ হাতে তৈরি এই মসজিদের সঙ্গে মিশে আছে সারাবিশ্বের মুসলমানের শ্রদ্ধা ও আবেগ।
এই মসজিদ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অবশ্যই যে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর প্রথম দিন থেকে তা বেশি হকদার যে, তুমি সেখানে সালাত কায়েম করতে দাঁড়াবে। সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।’ (সুরা তাওবা: ১০৮)
হিজরতের বছর ৬২২ সালে শুরু হয় মসজিদে নববির নির্মাণকাজ। ৬২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাত মাস সময় লেগেছে কাজ শেষ হতে। মদীনায় প্রবেশের পর রাসুল (স.)-এর উটনি ‘কাসওয়া’ যে স্থানটিতে বসে পড়েছিল, সেই স্থানেই তৈরি করা হয় ঐতিহাসিক মসজিদে নববি। মদিনার দুই এতিম বালক সাহল ও সোহাইলের কাছ থেকে ১০ দিনারের বিনিময়ে জায়গা কিনে নেওয়া হয়, যা হযরত আবু বকর (রা.) পরিশোধ করেন। জমির ছোট এক অংশে রাসুল (স.)-এর জন্য বাসস্থান এবং বাকি পুরো অংশে তৈরি করা হয় মসজিদ।
পৃথিবীর শীর্ষ পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে এটি দ্বিতীয়। একাধিক হাদিসসূত্রে জানা যায়, মসজিদে নববিতে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মসজিদে হারাম ছাড়া পৃথিবীর যেকোনো মসজিদে এক হাজার ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের চেয়েও উত্তম।’ (বুখারি: ১১৯০; মুসলিম: ১৩৯৪)
যুগে যুগে বহু সংস্কার ও সম্প্রসারণ হয়েছে এই মসজিদের। আব্দুল্লাহ ইবন উমরের বর্ণনা অনুযায়ী, রাসুল (স.)-এর যুগের মসজিদের ভিত্তি ছিল ইটের, ছাদ ছিলো খেজুরের ডালের এবং খুঁটি ছিলো খেজুর গাছের কাণ্ডের। সেসময় মসজিদের পরিধি ছিল আনুমানিক ২৫০০ মিটার। ৭ম হিজরিতে মসজিদে নববির প্রথম সম্প্রসারণ রাসুল (স.) নিজেই করেন। তখন আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৭৫ স্কয়ার মিটারে। এরপর ৬৩৮ সালে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) মসজিদে নববির সংস্কারে হাত দেন। মসজিদের চারপাশে জমি কিনে এর আয়তন বৃদ্ধি করেন। তবে যেদিকে উম্মাহাতুল মুমিনিনদের ঘর ছিলো সেদিকটা অপরিবর্তিত রাখা হয়।
এরপর ৬৫০ সালে তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.) মসজিদে নববি সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করেন। তিনি সর্বপ্রথম খোদাইকৃত পাথর ও প্লাস্টারের দেয়াল তৈরি করেন এবং খোদাইকৃত পাথর ও লোহার ব্যবহারে পিলার ও স্তম্ভ স্থাপন করেন। আর ছাদ নির্মাণ করেন কাঠ দিয়ে।
৭০৭ সালে খলিফা উমাইয়া শাসক ওলিদ ইবনে আব্দুল মালিকের নির্দেশে মক্কার গভর্নর ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ মসজিদে নববির সম্প্রসারণ করেন। সেসময় মসজিদের পরিধি বৃদ্ধি হয় ৬ হাজার ৪৪০ বর্গমিটার। তিনি মসজিদে চারটি মিনারা ও একটি মেহরাব স্থাপন করেন। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ স্তম্ভগুলোকে মরমর পাথর ও সোনার কারুকার্জ দিয়ে সাজান। এসময় স্তম্ভের সংখ্যা ছিল ২৩২টি। তিনি হজরত আয়েশা (রা.)-এর কক্ষটি মসজিদে নববির অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তার উপর নয়নাভিরাম সবুজ গম্বুজ স্থাপন করেন।
আব্বাসী খলিফা আল মাহদি ১৬১ থেকে ১৬৫ হিজরিতে মসজিদের আয়তন ৮হাজার ৮৯০ বর্গমিটারে উন্নিত করেন। ৬০টি জানালা ও ২৪টি দরজা লাগান তিনি।
৬৫৪ হিজরিতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে খলিফা আল মুতাসিম মসজিদে নববি পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু ৬৫৬ হিজরিতে তাতারিরা বাগদাদে হামলা করলে খলিফার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
মামলুক শাসনামলেও মসজিদে নববীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়। প্রধান চারটি ফটক ছাড়া অন্য দরজাগুলোকে পিতল দিয়ে নকশা ও সজ্জিত করা হয়।
উসমানি খলিফা সুলতান সুলেমান গম্বুজ মেরামত করেন এবং তার উপর সোনায় মোড়ানো চাঁদ স্থাপন করেন। ১২৭৭ হিজরিতে ফাটল দেখা দিলে সুলতান আব্দুল মাজিদ মসজিদের সংস্কার করেন। তখন মসজিদের আয়তন বেড়ে ১০ হাজার ৩০৩ বর্গমিটার হয়। এসময় তিনি পাঁচটি নতুন দরজা সংযুক্ত করেন এবং ১১ মিটার পর্যন্ত প্রাচীরের উচ্চতা বৃদ্ধি করেন। তাছাড়া ১৭০টি গম্বুজ ও ৬০০টি তেলপ্রদীপ স্থাপন করেন।
১৯০৯ সালে এই মসজিদের মাধ্যমেই আরব উপদ্বীপের বিদ্যুতায়ন শুরু হয়। সৌদি যুগ শুরু হলে বাদশাহ আব্দুল আজিজ ১৯৫০ সালে মসজিদে নববীর পরিধি ১৬ হাজার ৩২৭ বর্গমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। এসময় মসজিদের স্তম্ভ ছিল ৭০৬টি ও গম্বুজ ছিল ১৭০টি।
বাদশাহ আব্দুল আজিজের আমলে বিশেষ একটি স্টেশন থেকে রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টা মসজিদে বিদ্যুত সরবারাহ করা হতো। মসজিদে নববির মুখপাত্র আল হাত্তাব জানান, এসময় এখানে অন্তত ২ হাজার ৪২৭টি বাতি ছিলো।
১৯৭৩ সালে বাদশাহ ফয়সাল মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার বর্গমিটার জায়াগার বরাদ্দ দেন এবং সমগ্র এলাকাজুড়ে বৈদ্যুতিক পাখা, সাউন্ড সিস্টেম ও বিশেষ ছাতা স্থাপন করেন।
বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আজিজের পরে বাদশাহ ফাহাদের ১৪০৪ হিজরি থেকে দীর্ঘ ১০ বছরের সংস্কার ও সম্প্রসারণে তা নতুন অবকাঠামো লাভ করে। এতে মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি পায় ৮২ হাজার মিটার। এসময় চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করা হয়।
সবশেষ এবং সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণের কাজটি করেন বাদশাহ আব্দুল্লাহ। ২০১২ সালে তাঁর সংস্কারের পরে মসজিদে নববী একসঙ্গে ১৮ লাখ মুসল্লির নামাজ আদায়ের জন্য প্রস্তুত হয়।
বর্তমানের আকৃতিটি এরই পূর্ণরূপ। বাদশাহ আব্দুল্লাহর নির্দেশে মসজিদে বিশেষ কাঠামোতে তৈরি ২৫০টি ছাতা স্থাপন করা হয়। এসব ছাতা অন্তত এক লাখ ৩৪ হাজার বর্গমিটার এলাকায় ছায়া দিতে সক্ষম। দ্বি-স্তরবিশিষ্ট স্বয়ংক্রিয় এই ছাতাগুলো মুসল্লিদের বৃষ্টি ও সূর্যের তীব্র উত্তাপ থেকে সুরক্ষিত রাখে।
মসজিদের বর্তমান আয়তন সম্পর্কে সৌদি আরবের অর্থমন্ত্রী ইবরাহিম আসাফ জানান, মূল স্থাপনাটি অন্তত ৬ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত। আর মসজিদ ও আঙ্গিনা মিলে আয়তন ১০ লাখ ২০ হাজার ৫০০ বর্গমিটার।
‘হজরত মুহাম্মদ ও মদিনার নগরায়ণ’ শীর্ষক এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানানো হয়, মসজিদে নববির বর্তমান আয়তন নির্মাণকালীন আয়তনের চেয়ে প্রায় শত গুণ বড়। মসজিদের বর্তমান পরিধি প্রাচীন মদিনা নগরীর প্রায় সবটুকু অঞ্চল বেষ্টন করে নিয়েছে এমনকি মদীনা শহরের বাইরে থাকা জান্নাতুল বাকী মদিনার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ার পাশাপাশি তা মসজিদের নিকটবর্তী হয়ে পড়ে।
উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের শাসনামলে সংস্কার ও সম্প্রসারণের সময় মসজিদের সঙ্গে রওজাকে সংযুক্ত করে ফেলা হয়। রাসলুল্লাহ (স.)-এর বাসস্থানের কাছেই ছিলো তাঁর মেয়ে হযরত ফাতেমা (রা.) এর বাসস্থান। পরবর্তীতে এটিও মসজিদ স্থাপনার অর্ন্তভুক্ত হয়ে পড়ে।
মিম্বর ও রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ঘরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত রওজা শরিফ। হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (স.) বলেছেন, আমার ঘর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের একটি বাগান। (বুখারি: ১১২০; মুসলিম: ২৪৬৩)। নবীজির রওজা সবসময় খোলা থাকে। মসজিদের অন্যান্য স্থানের তুলনায় রওজায়ে আতহারকে আলাদা সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। রওজা শরিফের আয়তন ৩৩০ বর্গমিটার। দৈর্ঘে ২২ মিটার এবং প্রস্থে ১৫ মিটার।
রাসুল (স.)-এর ইন্তেকালের ৬৫০ বছর পর্যন্ত তাঁর রওজার উপর কোনো প্রকার গম্বুজ ছিলো না। ১২৭৯ সালে মিসরের মামলুক সুলতান সাইফউদ্দীন কালাউনের শাসনামলে প্রথম একটি কাঠের গম্বুজ তৈরি করা হয়। ১৪৮১ সালে মসজিদে নববিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে গম্বুজ ধ্বসে পড়ে। এতে নবী (স.)-এর কবর উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তৎকালীন মিসরের মামলুক সুলতান সাইফউদ্দীন আল-আশরাফ কাইতবে রওজার ওপরে কাঠের তৈরি গম্বুজটি নতুন করে তৈরি করেন এবং একে সীসার পাত দিয়ে ঢেকে দেন।
১৮১৮ সালে ওসমানি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ কাঠের গম্বুজটির ওপর বর্তমান ইটের তৈরি সবুজ গম্বুজটি তৈরি করেন। বর্তমান গম্বুজটি তৈরি হলে তা-ও প্রথম সাদা রঙে রাঙানো হয়। পরে তা তৎকালীন হিজাজী আরবদের রুচি অনুযায়ী নীল-বেগুনী রঙে রাঙানো হতো। ১৮৩৭ সালে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের আদেশে প্রথম গম্বুজটি সবুজ রঙে রাঙানো হয়। সবুজ গম্বুজটি নিচে বর্গাকৃতি এবং উপরে অষ্টভূজ আকৃতিতে তৈরি করা হয়েছে।
মসজিদে নববির সর্বপ্রথম মিম্বারটি তৈরি করা হয় খেজুরের তক্তা দিয়ে- এতে তিনটি ধাপ বা স্তর ছিল। অধিকাংশ মসজিদের সাধারণত মিহরাব থাকে একটি। কিন্তু মসজিদে নববিতে মিহরাবের সংখ্যা ছয়টি। একটি সুদৃশ্য পাঠাগার রয়েছে মসজিদটিতে। ১৩৫২ হিজরিতে এটি নির্মাণ করেন আওকাফ ডাইরেক্টর আবিদ মাদানি।
উল্লেখ্য, রাসুল (স.)-এর পাশে হজরত আবু বকর (রা.) এবং হজরত ওমর (রা.)-এর কবর এবং তৃতীয় একটি খালি কবর রয়েছে, যাতে কাউকে দাফন করা হয়নি। কোনো কোনো স্কলারের মতে, হজরত ঈসা (আ.) যখন পুনরায় পৃথিবীতে আসবেন, তখন তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার পর তাঁকে এখানেই দাফন করা হবে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মসজিদে নববিতে নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন। প্রিয়নবী (স.)-এর রওজার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।